এই হলো সরকার ও প্রসিকিউশনের অবস্থা

আজাদুর রহমান চন্দন

রাষ্ট্রপক্ষের অনেক দুর্বলতার বিষয় জানেন অনেকেই। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন টিমকে (রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদল) শক্তিশালী করার দাবি জানানো হয়েছে শুরু থেকেই। এক পর্যায়ে তদন্ত সংস্থা শক্তিশালী করা হলেও তাদের সঙ্গে কোনো গবেষক রাখা হয়নি। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, গবেষক নিয়োগের জন্য বারবার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে প্রসিকিউশন টিমের দু-একজন সদস্য ছাড়া অন্যদের পেশাগত জীবনে সাধারণ মামলা পরিচালনায়ও দক্ষতা দেখানোর নজির নেই। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলাসহ কয়েকটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ও ফরমাল চার্জ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেগুলোতে গণহত্যা ও সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির বিষয়গুলো স্পষ্ট করা হয়নি। জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম ও বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষস্থানীয় চার আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষরে দাখিল করা ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনাল প্রথম দফায় ফেরত দিয়েছিল সেগুলো সুবিন্যস্তভাবে লেখা না হওয়ায়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা উল্টো প্রসিকিউটরদের সাফাই গেয়েছেন। অথচ বিচার চলাকালে নানা দুর্বলতার জন্য প্রসিকিউশনকে ট্রাইব্যুনালের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে।

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়ছেন প্রসিকিউটর

এক প্রসিকিউটর নিয়ম ভঙ্গ করে নিম্ন আদালতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করেছেন৷ এ ছাড়া দুজনের বিরুদ্ধে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের মামলা থেকে মুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে৷ বেশ কিছু ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটরদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ পায় বিভিন্ন সময়ে। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের দ্বন্দ্বের কারণে এক পর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর দায়িত্ব পালন নিয়েও শুরু হয় টানাপড়েন।

গত ২০ জুন প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে৷ পুলিশ ও আদালত সূত্রের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত ৩১ মার্চ রাতে রাজধানীর দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার একটি ভবনে অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-৩-এর একটি দল অস্ত্রসহ নয়জনকে আটক করে৷ গত ১ এপ্রিল ওই নয়জনের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় অস্ত্র আইনে মামলা হয়৷ ৮ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজের আদালতে ওই নয় আসামির পক্ষে সাতজন আইনজীবীর ওকালতনামা ও জামিনের আবেদন দাখিল করা হয়৷ আসামিপক্ষের এই সাতজন আইনজীবীর মধ্যে প্রথমজন হলেন ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোখলেছুর রহমান (বাদল)৷ ২৭ এপ্রিল অস্ত্র মামলায় আসামিরা জামিন পান৷ ওই দিন জামিন আবেদনের শুনানিতে অন্য আইনজীবীদের সঙ্গে মোখলেছুর রহমানও অংশ নেন৷’ আইনত সরকারের আইন কর্মকর্তা বা রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করতে পারেন না৷ এ ছাড়া সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া ফৌজদারি মামলার আসামিদের পক্ষে মামলাও পরিচালনা করতে পারবেন না৷
প্রথম আলো জানায়, সাম্প্রতিক এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কর্মরত প্রসিকিউটরদের অন্য কোনো আদালতে মামলা পরিচালনার নিয়ম নেই৷ তার পরও একাধিক কৌঁসুলি হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালতে মামলা পরিচালনা করেন৷ এঁদের মধ্যে রয়েছেন মোখলেছুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, আবদুর রহমান হাওলাদার প্রমুখ৷ এই গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি গত মাসে আইন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে৷ আইন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়া ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত মামলা পরিচালনার পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোহাম্মদ আলী, আবদুর রহমান হাওলাদার প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলাও পরিচালনা করেছেন৷ উদহারণ হিসেবে বলা হয়, ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি সাভার থানার ঝাউচর গ্রামে আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুরের ঘটনায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ৫৩ জনকে আসামি করে সাভার থানায় মামলা হয়৷ সরকারের একজন মন্ত্রীর যোগসাজশে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আবদুর রহমান হাওলাদার ওই মামলায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের নির্দোষ প্রমাণ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পুলিশকে বাধ্য করেন৷ আবদুর রহমান আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক৷

রাষ্ট্রপক্ষে দ্বন্দ্ব 

গত ২৬ ফেব্র“য়ারি এক নম্বর ট্রাইব্যুনালে এক প্রসিকিউটরের ‘অস্বাভাবিক’ আরজিতে বিস্মিত হন তাঁর সহকর্মীরা। এক নম্বর ট্রাইব্যুনালে নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান বিচারপতি ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে প্রথম দিনের মতো কার্যক্রম শুরু হয় ওইদিন সকালে। কার্যতালিকায় ছিল জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মামলা। ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর মামলাটির কার্যক্রম শেষ হয়। মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) ছিল। রায়ের জন্য দিন ধার্য করতে রাষ্ট্রপক্ষের স্বাভাবিক আরজির বদলে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী মামলাটিতে নতুন করে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য তারিখ নির্ধারণের আরজি জানান। এতে এজলাসে উপস্থিত অন্য কয়েকজন প্রসিকিউটর বিস্ময় প্রকাশ করেন। এক প্রসিকিউটর তাঁর এক সহকর্মীকে ফিসফিস করে বলেন, ‘এটা কী হচ্ছে? তিনি তো আসামিপক্ষের আইনজীবীর মতো কাজ করছেন!’ যেহেতু রাষ্ট্রপক্ষই নতুন করে যুক্তি উপস্থাপনের আরজি জানিয়েছে, ফলে আসামিপরে আইনজীবী তাজুল ইসলামকে আর কিছুই করতে হয়নি। তিনি শুধু বলেন, যুক্তি উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুতি নিতে তাদের এক সপ্তাহ সময় প্রয়োজন। এ অবস্থায় ট্রাইব্যুনাল নতুন করে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য ১০ মার্চ দিন ধার্য করে। ওই ঘটনার পর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রসিকিউটর ক্ষোভ প্রকাশ করে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘মোহাম্মদ আলী রাষ্ট্রপক্ষের, না আসামিপক্ষের আইনজীবী, তা বোঝা গেল না।’ (সূত্র : প্রথম আলো, ২৮ ফেব্র“য়ারি ২০১৪)
চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও প্রসিকিউশন টিমের প্রধান সমন্বয়ক এম কে রহমানের মধ্যেও এক পর্যায়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। গত ১৬ মার্চ প্রসিকিউশন টিমের তৎকালীন প্রধান সমন্বয়ক এম কে রহমান চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে এড়িয়ে প্রসিকিউটরদের সভা ডাকেন। একই দিন গোলাম আরিফ টিপু ওই সভাকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাহার করার আবেদন জানিয়ে আরেকটি চিঠি পাঠান প্রসিকিউটরদের উদ্দেশে। পরদিন ১৭ মার্চ সকালের খবরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬ ও ১০ মার্চের দুটি সভায়ই রাষ্ট্রপক্ষের ২৩ কৌঁসুলির মধ্যে ১৪ জন উপস্থিত ছিলেন। এম কে রহমানের নির্দেশে প্রসিকিউটর হৃষিকেশ সাহা চিঠি দিয়ে সভা ডাকেন। এ প্রসঙ্গে হৃষিকেশ সাহা বলেন, ‘প্রধান সমন্বয়কারীর নির্দেশে আজকের (১৬ মার্চের) সভা ডাকা হয়।’ অন্যদিকে প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ‘আজকে প্রধান কৌঁসুলির কাছে দুই কৌঁসুলি অভিযোগ দাখিল করেছেন। এ অভিযোগের বিষয়ে কী হয়েছে, তা জানি না। প্রধান কৌঁসুলি নিজেও বিষয়টি দেখতে পারেন বা অভিযোগের নিয়ম অনুযায়ী একটি কমিটি গঠন করতে পারেন। অথবা বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিতে পারেন।’ সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, ‘কর্মেেত্র কাজের প্রতিযোগিতা থাকবে। সম্প্রতি কৌঁসুলিদের মধ্যে কিছু সমস্যা হয়েছে। সেজন্য আজ আমরা প্রধান সমন্বয়কারীর আহ্বানে সভায় বসেছিলাম। এটাকে অবৈধ আখ্যা দেওয়া ঠিক না। কারণ সরকার নির্বাহী আদেশে প্রধান সমন্বয়কারীকে নিয়োগ দিয়েছে।’ প্রসিকিউটর জেয়াদ-আল মালুম সভায় উপস্থিত ছিলেন না। তবে তিনি বলেন, সভা ডাকার এখতিয়ার প্রধান সমন্বয়কারীর নেই। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের ৭ ধারায় প্রসিকিউটর ও চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগের কথা বলা আছে। কিন্তু প্রধান সমন্বয়কের বিষয়ে কিছু বলা নেই। তাই প্রধান সমন্বয়ক নিয়োগ দেওয়া যায় না।
গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে কাজ করার জন্য প্রসিকিউশন টিমের তুরিন আফরোজকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ২৭ মার্চ তদন্ত সংস্থা জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে জমা দেয়। চিফ প্রসিকিউটর এ তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে ফরমাল চার্জ তৈরির জন্য তুরিন আফরোজকে সমন্বয়ক করে সাত প্রসিকিউটরের একটি টিম করে দেন। ওই টিমের অন্য ছয় সদস্য হলেন রানা দাশগুপ্ত, জেয়াদ-আল-মালুম, সুলতান মাহমুদ, এ কে এম সাইফুল ইসলাম, তাপস কান্তি বল ও রেজিয়া সুলতানা। তাঁদের মধ্যে প্রথম পাঁচজনই জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটর ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল সমমর্যাদার। পরে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান চিফ প্রসিকিউটর গত এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে। ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর হন সৈয়দ হায়দার আলী। তিনি গত ১১ মে নতুন সিদ্ধান্ত নেন জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তৈরির দায়িত্বে থাকা সাত প্রসিকিউটরের অনুপস্থিতিতে। সে অনুযায়ী গত ১৫ মে প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে একটি নোটিশ জারি করেন। নোটিশে বলা হয়, জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব নথিপত্র ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলীর কাছে হস্তান্তর করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রপক্ষের জ্যেষ্ঠ প্রসিকিউটররা ওই নথিপত্র পরীক্ষা করতে পারেন। ওই আদেশের পরই জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তৈরির কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। প্রসিকিউটর ঋষিকেশ সাহা কোন কর্তৃত্ববলে এই চিঠি দিয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। ওই চিঠিকে কেন্দ্র করে প্রসিকিউশন টিমের দ্বন্দ্ব আবারও প্রকাশ্যে চলে আসে।
এর আগে ২৫ মার্চ প্রসিকিউশনের দ্বন্দ্ব মেটাতে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক প্রসিকিউটরদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন। ওই বৈঠকে নির্দেশনা ছিল, দ্বন্দ্ব ভুলে একসঙ্গে কাজ করবেন প্রসিকিউটররা। কিন্তু আইনমন্ত্রীর সেই নির্দেশনা কাজে আসেনি।
চিফ প্রসিকিউটরের দায়িত্ব নিয়েও টানাপড়েন

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরদের দ্বন্দ্বের কারণে এক পর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর দায়িত্ব পালন নিয়েও শুরু হয় টানাপড়েন। চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান গত এপ্রিলে। চিফ প্রসিকিউটরের অবর্তমানে ২০ এপ্রিল থেকে সৈয়দ হায়দার আলীকে ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর করে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চিফ প্রসিকিউটর চিকিৎসা শেষে দেশে না ফেরা পর্যন্ত সৈয়দ হায়দার আলী ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। সিঙ্গাপুর থেকে এপ্রিল মাসেই চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরেন গোলাম আরিফ টিপু। স্বপদে যোগ দেওয়ার জন্য ৩০ এপ্রিল তিনি নিজ কার্যালয়ে যোগদানপত্র দেন এবং এর কপি আইন মন্ত্রণালয় ও ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে পাঠানোর জন্য ডেসপাস শাখাকে বলেন। অভিযোগ রয়েছে, ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর কৌশলে ওই যোগদানপত্রের কপি আটকে রাখেন। এ নিয়েও প্রসিকিউশনের এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করে। আর প্রসিকিউশন বা রাষ্ট্রপক্ষের দ্বন্দ্বে স্থবির হয়ে পড়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ তৈরির কার্যক্রম।
চিফ প্রসিকিউটর দায়িত্ব নেওয়ার পরও ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর কিভাবে থাকেন জানতে চাইলে গোলাম আরিফ টিপু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি মতার অপব্যবহার। আইন অনুযায়ী নয়, গায়ের জোরে এ রকম ভারপ্রাপ্তের পদ ধরে রাখা হয়েছে। এটি আশ্চর্য বিষয় বটে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আইন অনুযায়ী আমার যোগদানপত্র দেওয়ার পরপরই ভারপ্রাপ্ত তাঁর আগের পদে ফিরে যাবেন। এ জন্য কোনো প্রজ্ঞাপন বা নোটিশ জারির প্রয়োজন নেই।’ চিফ প্রসিকিউটর এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হলে আইন মেনেই প্রসিকিউশন চলার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রসিকিউশনের একটি পক্ষ দাবি করে, গোলাম আরিফ টিপুর যোগদানের চিঠি আটকে রাখে প্রসিকিউশনেরই আরেকটি পক্ষ। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটরদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও জামায়াতের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ তৈরির বিষয়ে গণমাধ্যমে যাতে কেউ মুখ খুলতে না পারেন, সে জন্য ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী কড়া ভাষায় প্রসিকিউটরদের চুপ থাকার আদেশ দেন। গত ২৩ এপ্রিল লেখা সৈয়দ হায়দার আলীর এক চিঠিতে বলা হয়, ‘প্রসিকিউটরদের কেউ কেউ বিভিন্ন মিডিয়ায় নিজেকে জাহির করার উদগ্র বাসনা চরিতার্থ করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে দ্বিধা করেন না। নিজেকে সরকারের উর্ধ্বে মনে করেন এবং বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেকে সেভাবেই তুলে ধরেন।’ ওই চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘ভবিষ্যতে এসব অসদাচরণ, অদতা, অবাধ্যতা ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে বিভাগীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ চিঠিতে সৈয়দ হায়দার আলী আরো লেখেন, ‘প্রত্যেক প্রসিকিউটরকে নিজের পরিচালিত মামলা ব্যতিরেকে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের অন্য কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কোনরূপ বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো।’
রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বলতার প্রকট প্রকাশ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায়
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা ছাড়াও আরো একাধিক মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ও ফরমাল চার্জ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেগুলোতে গণহত্যা ও সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির বিষয়গুলো স্পষ্ট করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমরা ৩(২)(গ) ধারায় আলাদাভাবে কোনো অভিযোগ উপস্থাপন করিনি, অভিযোগ এনেছি শুধু ৩(২) ধারায়।’ তিনি দাবি করেন, ৩(২) ধারায় সব অভিযোগই পড়ে।
কাদের মোল্লার বিচারের রায়ে বিচারকরা উল্লেখ করেছেন, ‘হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসমূহ, যা মানুষের বিবেককে দংশন করে, সেসব অপরাধের গভীরতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। আমরা সতর্কতার সঙ্গে অভিযুক্ত আসামির অপরাধের গভীরতা বিবেচনায় নিয়েছি। সুতরাং আমাদের রায় অবশ্যই অপরাধের গভীরতা ও আসামির ভূমিকার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।’ ট্রাইব্যুনালের এ মন্তব্যের পর ঘোষিত দণ্ড দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি অপরাধের গভীরতার তুলনায় এর সঙ্গে আসামির সংশ্লিষ্টতা ততটা গভীর নয়? নাকি তদন্ত প্রতিবেদন ও ফরমাল চার্জে অপরাধের সঙ্গে আসামির সংশ্লিষ্টতা ততটা জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়নি? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে অভিযোগ ও স্যাক্ষ-প্রমাণ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বলতা ধরা পড়েছে। এ বিচারপ্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপ গণহত্যার (Genocide) বিষয়টিকে ব্যাপক হত্যার (mass killing) সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। একসঙ্গে বেশি লোক হত্যাকেই তারা বিবৃত করেছে গণহত্যা হিসেবে। অথচ ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে জেনোসাইড বলতে মাস কিলিংকেই শুধু বোঝানো হয়নি; বরং কোনো জাতি, নৃগোষ্ঠী, বর্ণগত, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে পুরোপুরি বা অংশবিশেষ ধ্বংস করার ল্েয ওই জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা, এমনকি তাদের দৈহিক বা মানসিক তিসাধনকেও বোঝানো হয়েছে। জেনেভা কনভেনশনেও জেনোসাইডের এ রকম সংজ্ঞাই দেওয়া হয়েছে।
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ব্যাপক হত্যা ও ধর্ষণের ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। প্রমাণিত পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে দুটি অভিযোগের (মিরপুরের আলোকদী গ্রামে ব্যাপক হত্যা ও ধর্ষণ) দায়ে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি তিনটি অভিযোগে তাঁকে দেওয়া হয়েছে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড। অথচ এগুলোও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ। এসব হত্যা ও ব্যাপক হত্যার দায়ে কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি, অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে–এটিই ছিল জাতির প্রত্যাশা। এর আগে বাচ্চু রাজাকার নামে পরিচিত আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে মামলায় তাঁকে সর্বোচ্চ সাজাই দেওয়া হয়েছে। অথচ ওই বাচ্চু রাজাকার একাত্তরে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী বাহিনীর কোনো বড় মাপের নেতা বা কমান্ডার ছিলেন না, ছিলেন একজন স্থানীয় পাতি নেতা। অন্যদিকে কাদের মোল্লা ছিলেন কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর হাইকমান্ডের সদস্য। ওই গোপন কমান্ডো বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল। অথচ ওই বাহিনীর কামান্ডার বা সুপিরিয়র অফিসার (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) হিসেবে কাদের মোল্লাকে আইসিটি অ্যাক্টের ৪(২) ধারা অনুযায়ী দায়ী করা হয়নি। এটিও রাষ্ট্রপক্ষের একটি বড় ব্যর্থতা।
চার মামলার ফরমাল চার্জ ফেরত
সবাই জানেন, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম ও বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষস্থানীয় চার আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপরে দাখিল করা ফরমাল চার্জ ট্রাইব্যুনাল প্রথম দফায় ফেরত দিয়েছিল সেগুলো সুবিন্যস্তভাবে লেখা না হওয়ায়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা উল্টো প্রসিকিউটরদের সাফাই গেয়েছেন। অথচ বিচার চলাকালে নানা দুর্বলতার জন্য প্রসিকিউশনকে ট্রাইব্যুনালের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে। সেসব খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিতও হয়েছে।
২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে না নিয়ে ফেরত দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারির মধ্যে নতুন করে অভিযোগ দাখিল করতে রাষ্ট্রপকে নির্দেশ দেওয়া হয়। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেওয়ার বিষয়ে আদেশের ধার্য দিন ছিল ২০১১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। ট্রাইব্যুনাল ওই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ রাষ্ট্রপরে প্রধান কৌঁসুলির কাছে ফেরত পাঠানোর এবং তা পদ্ধতি অনুযায়ী ৫ জানুয়ারির মধ্যে পুনর্দাখিলের আদেশ দেয়। আদেশে বলা হয়, গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ, তদন্ত প্রতিবেদন, সাীদের জবানবন্দি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক নথি পর্যবেণ করে ট্রাইব্যুনাল মনে করে, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ অগোছালোভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে। অভিযোগগুলো সুবিন্যস্ত নয় এবং শ্রেণীভুক্ত করা হয়নি। ট্রাইব্যুনালের তখনকার রেজিস্ট্রার মো. শাহিনুর ইসলাম পরে সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালের কার্যপ্রণালী বিধিমালার ৪৬ বিধিতে বর্ণিত অন্তর্নিহিত মতাবলে ন্যায়বিচারের স্বার্থে ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দিয়েছে।

তবু ব্যর্থতা মানতে নারাজ প্রসিকিউশন ও সরকার
সুবিন্যস্তভাবে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ প্রস্তুত করতে না পারা রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের সীমাবদ্ধতা নাকি ব্যর্থতা–এ প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জেয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা আমাদের ব্যর্থতাও নয়, সীমাবদ্ধতাও নয়।’ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সকালে আদালতে গিয়েছিলাম। তবে আদালত জানিয়েছে, গোলাম আযমের অভিযোগের কাগজপত্রগুলো গোছানো ছিল না।’ পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরও কেন সঠিক নিয়মে প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা ব্যর্থতাও নয়, সীমাবদ্ধতাও নয়। ট্রাইব্যুনালের আন্তর্জাতিক মান রা এবং সতর্কতার জন্যই আদালত এ ধরনের আদেশ দিয়েছে। আদালত চায় অভিযোগের বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট এবং গ্র“প অনুসারে ভাগ করে প্রতিবেদন আকারে জমা দেওয়া হোক। আমরা আবারো গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের প্রতিবেদনটি জমা দেব।’
চিফ প্রসিকিউটর সাহেব ‘গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের প্রতিবেদন’ জমা দেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে কারোরই যুদ্ধাপরাধের বিচার করার উদ্যোগ নেই।
গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ফেরত দেওয়ার ঘটনাকে প্রসিকিউশনের ব্যর্থতা বলে মনে করেননি তখনকার আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ ফেরত দেওয়ার পরদিন সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘অন্যদের ঘটনার ব্যাপকতা নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে। কিন্তু গোলাম আযমের ক্ষেত্রে ঘটনার ব্যাপকতা দেশজুড়ে বিস্তৃত। গোলাম আযম একাত্তরে বিভিন্ন জায়গায় মিটিং করেছেন। এর ফলে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সে ব্যাপারে আরো বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেওয়ার প্রয়োজন আছে।’
ট্রাইব্যুনাল কিন্তু আরো বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিতে বা তদন্ত করতে বলেনি, বলেছে অভিযোগগুলো সুবিন্যস্ত ও শ্রেণীভুক্ত করে লিখতে। কাজেই মন্ত্রী ও প্রসিকিউটরদের সাফাইমূলক বক্তব্য ধোপে টেকে না। এখানে না বলে পারছি না, গোলাম আযমের বিষয়ে একটি প্রতিবেদনের রূপরেখা অনেক আগেই প্রসিকিউশনের কয়েকজন সদস্যকে দিয়েছিলাম। তাতে অপরাধগুলো গ্র“প অনুসারে সাজানো ছিল।
মোবারকের মামলায় নিজেদের নথি প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ!
নিজেদের দাখিল করা নথির সত্যতা প্রমাণে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতার কারণে মো. মোবারক হোসেনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কার্যক্রম পিছিয়ে গেছে। ২৭ মে পর্যন্ত এ মামলার যুক্তি উপস্থাপন মুলতবি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। মোবারক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা।
বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ গত ২১ মে এ মামলায় চূড়ান্ত যুক্তি উপস্থাপন শেষ হতে পারত। কিন্তু আসামিপরে যুক্তি খণ্ডনকালে ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নের মুখে রাষ্ট্রপ খেই হারিয়ে ফেলে। যত্ন নিয়ে মামলা পরিচালনা না করায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনাল বলে, বিপুল পরিমাণ অপ্রয়োজনীয় নথি দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ সরকারি অর্থ অপচয় করেছে।
সেদিন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমের শুরুতে প্রথমে যুক্তি দেন আসামিপক্ষের আইনজীবী তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা শান্তি কমিটির তালিকায় মোবারক হাজির নাম উলেখ রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের নথি অনুসারে মোবারকের বয়স তখন ২১ বছর। ওই বয়সে তিনি কীভাবে হাজি হলেন? এ ছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের নথিতে তাকে আখাউড়া থানার রাজাকার কমান্ডার উলেখ করা হয়েছে। অথচ আখাউড়া থানা গঠিত হয়েছে ১৯৭৬ সালে। তাহলে তিনি কীভাবে একাত্তর সালে আখাউড়া থানার রাজাকার কমান্ডার হলেন?
পরে যুক্তি খণ্ডন শুরু করেন রাষ্ট্রপরে কৌঁসুলি সাহিদুর রহমান। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বিভিন্ন প্রশ্ন করলে তিনি সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি।
এ মামলায় রাষ্ট্রপরে দাখিল করা বিপুল পরিমাণ নথিপত্র দেখিয়ে ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষকে বলেন, ‘আপনাদের দাখিল করা নথি থেকে সংশিষ্ট মাত্র ১০ পৃষ্ঠার ওপর যুক্তি দিয়েছেন। তাহলে বাকি পৃষ্ঠাগুলো কেন ট্রাইব্যুনালে জমা দিলেন? প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) এ মামলায় মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বীরাঙ্গনাদের একটি তালিকা দিয়েছে, যা এ মামলার কোনো অভিযোগের সঙ্গে সংশিষ্ট নয়। এগুলো অপ্রয়োজনে জমা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর ওপর আপনাদের প্রতিপ যুক্তি দিয়েছে এবং প্রশ্ন তোলার সুযোগ পেয়েছে।’
রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা নথিপত্রের ১০৬ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি ফুটনোটে লেখা ‘এএসপি হেলাল কথা বলুন। পরের কপিগুলো সত্যায়িত নহে’। ট্রাইব্যুনাল ওই পৃষ্ঠার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাহিদুর রহমানকে বলেন, ‘এ ফুটনোট তদন্ত কর্মকর্তা রাষ্ট্রপকে দিয়েছেন। আপনি এ ফুটনোটসহ নথি ট্রাইব্যুনালে জমা দিয়েছেন। আপনি এটা দেখারও সময় পাননি!…আমরা আর কিছু বলতে পারছি না, এখানে সাংবাদিকেরা উপস্থিত আছেন।’
মামলার নথি হিসেবে রাষ্ট্রপক্ষরে দাখিল করা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাওয়া রাজাকার তালিকার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গত ১৮ মে ট্রাইব্যুনাল প্রশ্ন তুলেছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে ফোন করে এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সেদিন রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। ২১ মে ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাহিদুর রহমান জবাব দিতে পারেননি। মোবারকের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার অনেক পরে ২০১২ সালে রাজাকারদের ওই তালিকা তৈরি করা হয়। ওই তালিকায় মোবারকের নাম রয়েছে।
এদিকে মোবারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের প্রায় এক বছর পর এবং যখন মামলার কার্যক্রম শেষ হওয়ার পথে, তখন ২১ মে অভিযোগ গঠনের আদেশে সংশোধনী আনার আরজি জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। গত বছরের ২৩ এপ্রিল এই ট্রাইব্যুনাল মোবারকের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ গঠন করেন। তৃতীয় অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ১১ নভেম্বর রাত নয়টার দিকে মোবারক তার সশস্ত্র রাজাকার সহযোগীদের নিয়ে ছাতিয়ান গ্রামের আবদুল খালেককে অপহরণ করে সুহিলপুর ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যান ও শারীরিক নির্যাতন করেন। ওই রাতেই খালেককে তিতাস নদীর পশ্চিম পাড়ে বাকাইল ঘাটে নিয়ে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু সাীর স্যা অনুসারে, ওই ঘটনা রাত ৯টায় নয়, সকাল ৯টায় ঘটেছে। একই ঘটনায় সময়ের এ পার্থক্য নিয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপরে ভারপ্রাপ্ত প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী তা সংশোধন করে দেওয়ার আরজি জানান। তবে এর জোরালো বিরোধিতা করে আসামিপক্ষরে আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আসামিপ রাত ৯টা মনে করে সাীকে জেরা করেছে। এখন যদি সংশোধন করে সকাল ৯টা করা হয়, তবে আসামিপ কী আবার জেরা করার সুযোগ পাবে?’
এ পর্যায়ে হায়দার আলী বলেন, এমন ভুল হতেই পারে। এটা সংশোধন করলে কোনো সমস্যা নেই।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপকে বলেন, ‘আপনারা হাঁটতে হাঁটতে বলবেন আর ট্রাইব্যুনাল তা ঠিক করে দেবেন?’ হায়দার আলী বলেন, তারা সংশোধনীর জন্য লিখিত আবেদন জমা দেবেন। পরে ওই আবেদন জমা ও ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন প্রশ্নের রাষ্ট্রপরে জবাবের জন্য যুক্তি উপস্থাপন ২৭ মে পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
প্রসিকিউশনকে বারবার ভর্ৎসনা ট্রাইব্যুনালের
নাগরিকদের দিক থেকে বারবার সমালোচনা সত্ত্বেও টনক নড়েনি সরকারের। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে মানসম্পন্ন প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপরে আইনজীবীদল) গড়ার কোনো উদ্যোগই নেয়নি সরকার। প্রসিকিউশনের ব্যর্থতায় এর আগে গোলাম আযমসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ ফেরত দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় সাী হাজির করতে বারবার ব্যর্থ হয় প্রসিকিউশন। আর কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় যা ঘটেছে তাতে কেলেঙ্কারির একশেষ!
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে তদন্তে গাফিলতির কারণে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ বুধবার ক্ষোভ প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনাল। আর এ কারণে তদন্ত কর্মকর্তাকে তলবও করা হয়। ট্রাইব্যুনালের তখনকার চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে সেদিন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী সাতটি অভিযোগ উত্থাপন করেন। উপিস্থত একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে জানা যায়, ট্রাইব্যুনালে মোহাম্মদ আলী বলেন, মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র শফিক পল্লবকে নবাবপুর থেকে ধরে মিরপুরে কাদের মোল্লার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তার নির্দেশে পল্লবকে ১২ নম্বর সেকশনে একটি গাছে ঝুলিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে আরো পাঁচজনের সঙ্গে তাঁকে কালাপানি এলাকায় মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ অভিযোগের পে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ২০০৭ সালে শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত ‘একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ নামের একটি বই উপস্থাপন করেন। ওই সময় ট্রাইব্যুনাল জানতে চায়, ‘এ বই ছাড়া আর কোনো সাী বা প্রমাণ নেই?’ জবাবে প্রসিকিউটর বলেন, ‘পাওয়া যায়নি।’ এরপর বিচারক বলেন, ‘ওই বইতেই উল্লেখ আছে, ফজর আলী নামের এক ব্যক্তি গণতদন্ত কমিশনের কাছে ওই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন। শাহরিয়ার কবির লোকটিকে পেলেন, আর আপনারা পেলেন না–এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? আসলে আপনারা ঘটনাস্থলেই যাননি বলে মনে হয়। শাহরিয়ার কবিরের বই থেকে তুলে দিয়েছেন।’ এরপর তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করে ট্রাইব্যুনাল।
পরে কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যার অভিযোগ তুলে ধরেন প্রসিকিউটর। ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কাদের মোল্লার সম্পৃক্ততা প্রমাণের জন্য কোনো সাী আছে কি না তা প্রসিকিউটরের কাছে জানতে চায় ট্রাইব্যুনাল। জবাবে প্রসিকিউটর ২০০৭ সালে ভোরের কাগজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন এবং শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত বইটির কথা বলেন। তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা কাউকে পাননি। তখন শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত বইটির উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখানে শহিদুর রহমান চৌধুরী নামের এক ব্যক্তিকে সাী হিসেবে দেখা যায়। শাহরিয়ার কবির সাহেব তাঁকে পেলেন। আর আপনারা পেলেন না?’ বিচারক বলেন, ‘১৯৭২ সালের পর থেকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শতাধিক রিপোর্ট হয়েছে। অথচ আপনারা একটিও পেলেন না। আমরা সব জানি। আর্কাইভ খোঁজেন। বেগম পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ৬৬, পাটুয়াটুলী যান। ঠিকানা দিলাম।’
এরপর প্রসিকিউটর শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়া থেকে হাজার হাজার লোককে ধরে নিয়ে শিয়ালবাড়ী এলাকায় নিয়ে হত্যা করার সঙ্গে কাদের মোল্লা জড়িত বলে অভিযোগ উত্থাপন করেন। কিন্তু যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের কোনো নাম-ঠিকানা তিনি বলতে পারেননি। ওই সময় বিচারক বলেন, ‘কিসের ভিত্তিতে এ অভিযোগ আনলেন?’ জবাবে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, লোক মুখে শুনে। এরপর ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান চরম ােভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভেগের (াধমঁব) একটা সীমা আছে।’
২০১২ সালের ৯ এপ্রিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের প্রস্তুতির অভাব এবং আসামিপরে আইনজীবীর অনুপস্থিতির কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। ওইদিন প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেেিত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার কার্যক্রম দুপুর পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া মুলতবি করা হয় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলার শুনানি। প্রসিকিউশনের কাছে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক জানতে চান, ‘এভাবে চললে জাতি কী সংকেত পাবে?’ প্রথম আলোর অনলাইনেও একই সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। বিডিনিউজ জানায়, সকালে আদালতের কার্যক্রম শুরুর পর প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী ট্রাইব্যুনাল বলেন, সাঈদীর মামলার কিছু নথি এখনো আদালতে পৌঁছেনি। প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী সেগুলো নিয়ে আসছেন। এ কারণে শুনানি শুরু করতে আরো সময় প্রয়োজন। ওই সময় বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, ‘আপনার এই আবেদনে আদালত অসন্তুষ্ট।’ এরপর চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, ‘চিফ প্রসিকিউটর সাহেব, আমরা তাহলে এখানে ঘুমিয়ে থাকি। আপনার প্রসিকিউটর আসুক, রাজ্জাক সাহেব (আসামি পরে আইনজীবী) আসুক, আমরা ঘুমাই। বারবার এভাবে মামলার কার্যক্রম মুলতবি করা হচ্ছে। বেলা দুইটার মধ্যে কোর্ট নেমে গেলে পাবলিককে কী সিগন্যাল দেব?’ এরপর সাঈদীর মামলার কার্যক্রম দুপুর পর্যন্ত পিছিয়ে দেন বিচারক।
এদিকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানিতে তার আইনজীবীদের যুক্তি উপস্থাপনের জন্য দিন রাখা ছিল ৯ এপ্রিল। কিন্তু তার পরে প্রধান আইনজীবী আব্দুর রাজ্জাক দেশের বাইরে থাকায় শুনানি মুলতবি করে দেন বিচারপতি নিজামুল হক।
আগেরদিন ৮ এপ্রিল বিডিনিউজ জানায়, নথিবিভ্রাটের কারণে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে রাজাকার হিসেবে ট্রাইব্যুনালে নথিভুক্ত করতে পারেনি প্রসিকিউশন। প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, একাত্তরে পিরোজপুরের পাড়েরহাটে রাজাকার বাহিনী গঠনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন সাঈদী। এর পে তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনে তথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, আসামিপ নথিপত্রের এই অংশটি পায়নি। এ নিয়ে প্রসিকিউশন ও আসামিপরে আইনজীবীদের বদানুবাদে আদালতের পরিবেশ কিছু সময়ের জন্য উত্তপ্ত হয়ে উঠে। পরে সাঈদীর আইনজীবীদের আপত্তিতে ট্রাইব্যুনালেরও সায় আসে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক তদন্ত কর্মকর্তার স্যাগ্রহণ পরদিন পর্যন্ত মুলতবি করেন।
এর আগে ১৫ মার্চ মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মামলায়ও ট্রাইব্যুনালের তোপের মুখে পড়ে প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা। ২০১২ সালের ১৬ মার্চ প্রথম আলো প্রধান শিরোনাম করেছে বিষয়টি। ‘তদন্ত নিয়ে ট্রাইব্যুনাল আবারও অসন্তুষ্ট’ শিরোনামে পত্রিকাটি লিখেছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তদন্ত নিয়ে আবারও অসন্তোষ প্রকাশ করলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গতকাল বৃহস্পতিবার জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর মামলার শুনানিতে তদন্ত সঠিকভাবে হচ্ছে না বলে অসন্তোষ জানান ট্রাইব্যুনাল। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিকে ট্রাইব্যুনালের জেরার মুখে পড়তে হয়।’
পত্রিকাটি জানায়, নিজামীর মামলার শুনানিতে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের উদ্দেশে বলে, তদন্ত সঠিকভাবে হচ্ছে না। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে আলবদর বাহিনীর হাতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য অভিযোগে উল্লেখ নেই। রাষ্ট্রপরে কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী এ সময় ট্রাইব্যুনালকে বলেন, অভিযোগ প্রমাণের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ রাষ্ট্রপরে হাতে আছে। সাীদের জবানবন্দিতে এগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত নিয়ে ট্রাইব্যুনালের অসন্তোষ প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির ওই পত্রিকাকে বলেন, নির্মূল কমিটির প থেকে তদন্ত সংস্থা ও রাষ্ট্রপক্ষকে যখন বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ দেওয়া হয়েছিল, তখন এগুলো একাধিক সূত্র থেকে যাচাই-বাছাই করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন দায়সারা তদন্ত করায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। শাহরিয়ার কবির আরো বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের বেশির ভাগ কৌঁসুলি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনার মতো যোগ্য ও দতাসম্পন্ন নন। তাঁদের অনেকেই বাইরে ওকালতি করেন, ফলে এই মামলায় সময় দিতে পারেন না। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এই কৌঁসুলিদের দিয়েই হবে।’
ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষ নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৫টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উপস্থাপন করে। ১৩ নম্বর অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরে মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রথমে পাকিস্তানি সেনারা এবং পরে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। ওখান থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী আলবদর বাহিনী বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটায়। গোলাম আযম ও নিজামী সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন এবং ষড়যন্ত্রে অংশ নিতেন। অভিযোগ উপস্থাপন শেষ হলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আলতাফ উদ্দিন আহমেদের কাছে ট্রাইব্যুনাল জানতে চায়, ‘১৫ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, পাবনা জেলার সাঁথিয়া থানার পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্পে নিজামী নিয়মিত যেতেন এবং রাজাকারদের পরামর্শ দিতেন ও ষড়যন্ত্র করতেন। এখানে নিজামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২)(এ) ও ৩(২)(জি) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। ৩(২)(এ) ধারা কেন আনা হলো? পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করে থাকলে কেন এই ধারা আসবে?’
আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৩(২)(এ) ধারায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যেমন–হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ প্রভৃতি এবং ৩(২)(জি) ধারায় এসব অপরাধের সহযোগিতা বা ষড়যন্ত্রের কথা বলা আছে।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি জবাবে বলেন, রাজাকার ক্যাম্পে গিয়ে নিজামী ষড়যন্ত্র করেছেন বলেই রাজাকাররা বিভিন্ন অপরাধ করেছে। বিচারক বলেন, কিন্তু অভিযোগে কোথাও বলা হয়নি যে নিজামীর ষড়যন্ত্রের ফলে রাজাকাররা সেসব অপরাধ করেছে। ট্রাইব্যুনালের সামনে এগুলো স্পষ্ট করতে হবে। প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, সাক্ষীদের জবানবন্দিতে এ বিষয়গুলো আছে। বিচারক বলেন, ‘কিন্তু সেটা আনুষ্ঠানিক অভিযোগে উল্লেখ নেই। এটা কি ট্রাইব্যুনালের মাথায় রাখতে হবে? অবশ্যই এখানে উল্লেখ করতে হবে, ষড়যন্ত্রের ফলে এসব অপরাধ ঘটেছে। কারণ, প্রতিটি অভিযোগ স্বতন্ত্র।’
সাইফুল ইসলামের কার্যক্রমে অসন্তোষ : ২০১৩ সালের ২৫ মার্চ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবরে বলা হয়, জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউটর এ কে এম সাইফুল ইসলামের কার্যক্রমে স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২৫ মার্চ সোমবার ছিল প্রসিকিউশনের যুক্তি উপস্থাপনের দ্বিতীয় দিন। সাইফুল ইসলাম যুক্তি উপস্থাপনের সময় অসংলগ্নতা ধরা পড়ে ট্রাইব্যুনালের চোখে। শুনানি শুরুর কিছুণ পরই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ওবায়দুল হাসান প্রসিকিউটরকে বলেন, ‘আপনার প্রস্তুতি নেই, যদিও আপনাকে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছে।’ বিচারক বলেন, ‘আপনি আজ কাজ করবেন, নাকি ঘুমাবেন, সেটা ঠিক করুন।’ তখন প্রসিকিউটর সাইফুল আমতা আমতা করে বলেন, ‘রাতে বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। কম্পিউটারে যে ডাটা তৈরি ছিল, তা ভুলে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়নি। আমার খাতাটাও নিচে রয়েছে।’ এ কথা বলে তিনি পেছনে ফিরে সহযোগীদের তা নিয়ে আসতে ইশারা করেন। তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটা কোনো যৌক্তিক অজুহাত হতে পারে না।’ প্রসিকিউটরের কার্যক্রমে অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, ‘আপনারা রায়ের আগে ক্যামেরার সামনে বলেন, সব অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছেন। টক শো-তে বলেন, বিচারক ফাঁসি দেবেই, তবে এটা ভুলে যাবেন না আপনাদের যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনই প্রমাণ করবে আসামিরা ছাড়া পাবে, নাকি মুক্তি।’
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দুজন সাক্ষীর বর্ণনা এক হলেও সময়ের ফারাক ছিল। বিষয়টি যুক্তি উপস্থাপনের সময় বেরিয়ে এলেও প্রসিকিউটর দাবি করেন, তিনি সন্দেহাতীতভাবে আসামির অপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছেন। ট্রাইব্যুনালকে তিনি বলেন, ‘সাক্ষীর স্মৃতি বিভ্রাটের কারণে একটি ঘটনার সময় দুজন দুই রকম বলেছেন।’ ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারকের একজন শাহিনুর ইসলাম বলেন, ‘স্মৃতি বিভ্রাটের কারণে এমন হতে পারে না।’ ওই সময় আসামি কামারুজ্জামানকে কাঠগড়ায় বসে হাসতে দেখা যায়। ওই দিন বিকেলে দ্বিতীয় দফায় যুক্তি উপস্থাপনের সময় প্রসিকিউটর সাইফুলের উদ্দেশে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সরাসরি বলেন, ‘আমরা আপনার যুক্তি উপস্থাপনে সন্তুষ্ট না। আপনি ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে চেষ্টা করবেন। কেস ভালোভাবে প্লেইস করবেন এটা আমরা চাই।’
উল্টাপাল্টা আচরণ করে পরে দুঃখ প্রকাশ মালুমের : আগের দিন ২৪ মার্চ রবিবারও ট্রাইব্যুনালে উল্টাপাল্টা আচরণ করে পরে দুঃখ প্রকাশ করেন একজন সিনিয়র প্রসিকিউটর। ওই দিন এক নম্বর ট্রাইব্যুনালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলা তালিকায় এক নম্বরে এবং গোলাম আযমের পে যুক্তির জন্য ২ নম্বরে ছিল। প্রাইম খবর ডটকমসহ দুটি নিউজ পোর্টালের খবরে বলা হয়, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পে তার আইনজীবী এ এইচ এম আহসানুল হক হেনার পরপরই প্রিজন সেলে গোলাম আযমের সঙ্গে তার আইনজীবীদের দেখা করার অনুমতি চেয়ে আবেদন জানান গোলাম আযমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। ওই সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী এ এইচ এম আহসানুল হক হেনা ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘আজকে যেহেতু গোলাম আযম সাহেবের মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে কার্যদিবসের পুরো সময় লাগবে তাই সোমবার পর্যন্ত আমাদের মামলা মুলতবির আবেদন জানাচ্ছি।’ তখন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সাকা চৌধুরী বলে সম্বোধন করে এ আবেদনের আপত্তি জানাতে গেলে ডিফেন্সের আইনজীবী এ এইচএম আবু হেনা ট্রাইব্যুনালের কাছে জোর আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘উনি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সাকা চৌধুরী বলে সম্বোধন করতে পারেন না। ওনাকে (জেয়াদ আল মালুম) যদি কোনো বিকৃত নামে ডাকা হয় তাহলে উনার কেমন লাগবে?’ তখন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিষয়টি জানতে চেয়ে সতর্ক করতে গেলে মালুম উত্তেজিত ভঙ্গিতে বিচারকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমাকে দেখতে পারেন না কেন?’ ওই সময় তিনি (মালুম) ট্রাইব্যুনালকে আরো বলেন, ‘আমাকে কারণে-অকারণে ধমকান কেন?’ ওই সময় বিচারক বলেন, ‘আপনাকে আমি ধমকাবো কেন? আপনাকে ধমকিয়ে আমার কোনো লাভ আছে? এসব আপনি কী বলছেন মালুম সাহেব?’ এমন পরিস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির প্রসিকিউটর মালুমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘কোনো বিষয়ে আপনি মনঃক্ষুন্ন হতে পারেন। কিন্তু ওপেন কোর্টে দাঁড়িয়ে এসব বলতে পারেন না।’ তখন প্রসিকিউটর আবদুর রহমান হাওলাদার উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। পরে জেয়াদ আল মালুমও এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক বলেন, ‘মিস্টার জেয়াদ আল মালুম বলুন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী আহসানুল হক হেনা সাহেবের আবেদন আপনার কথামতো রিজেক্ট করে তার মামলার কার্যক্রম কি বন্ধ রাখতে পারবো আমরা? আপনি এই কথার জবাব দেন।’ বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হক আরো বলেন, ‘আপনি কি চান তাকে সারাদিন বসিয়ে রাখি? যদি বলেন, তাকে বসিয়ে রেখে কোনো লাভ হয় বলতে পারেন।’ মালুম ওই সময় চুপ থাকেন।
রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠার দলিল ছিল না কারো হাতেই
একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে প্রায় সব মামলায়ই রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেছে, ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে খুলনায় জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসুফ রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। তদন্ত সংস্থাও প্রতিবেদনে এ রকম তথ্যই দিয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে কয়েকজন গবেষকও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একই কথা বলেছেন এ বিষয়ে। আর আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও সবার কাছেই জানতে চেয়েছেন এ ধরনের কোনো তথ্য ১৯৭১ সালে কোনো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল কি না। তদন্ত কর্মকর্তা, প্রসিকিউটর, গবেষক–সবাই বলেছেন, ‘জানা নেই’।
আমি নিশ্চিত, আসামিপক্ষের আইনজীবীরা একাত্তরের পত্রপত্রিকা ঘেঁটে এ ধরনের কোনো তথ্য পাননি। তাই তারা ধরে নিয়েছেন, খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত কোনো খবর ওই সময় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। ফলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য সবাইকেই প্রশ্নটি করছেন তারা।
সব মামলায়ই যে বিষয়টি সামনে আসবে সে কথা পরিচিত প্রসিকিউটরদের শুরু থেকেই বলে আসছিলাম। সবশেষে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে মত দিতে গিয়েও জানাই যে খুলনায় রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত দলিল নেই প্রতিবেদনটিতে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনের আরো অনেক ঘাটতি উল্লেখ করে সেগুলো পূরণ করার জন্য বিভিন্ন তথ্য, দিকনির্দেশনা ও দলিল দিয়ে প্রসিকিউশনকে সহায়তা করার চেষ্টা করেছি। এমনকি গোলাম আযমসহ বেশ কয়েকজনের মামলার জন্য প্রয়োজনীয় দলিলপত্রসহ আলাদা আলাদা পেপার তৈরি করে দিয়েছি, যাতে রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত একাত্তরের একাধিক পত্রিকার রিপোর্টও ছিল। আসলে পত্রিকার ওই রিপোর্টটির শিরোনাম দেখে বোঝা যায় না যে এর মধ্যে রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তথ্য থাকতে পারে। সম্ভবত এতেই বিভ্রান্ত হন বিজ্ঞ প্রসিকিউটররা। পরে এ কে এম ইউসুফের মামলার তদন্ত শুরু হলে তদন্ত কর্মকর্তা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এ বিষয়টিসহ মামলার অন্যান্য বিষয় স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য।
জোরালো অপপ্রচারের দুর্বল-অস্পষ্ট জবাব
এ বিচার নিয়ে আসামিপ, তাদের রাজনৈতিক মিত্র ও দেশি-বিদেশি লবিস্টরা শুরু থেকেই জোরালো অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের বিচার না করে তাদের সহযোগীদের বিচার করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা। এমনকি এমন দাবিও তারা তুলে যে বিচার যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হচ্ছে, তাহলে প্রত্যেক মহাদেশ থেকে একজন করে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হোক। জবাবে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা শুধু বলেছেন, এটি ডমেস্টিক (দেশীয়) ট্রাইব্যুনাল, তাই এখানে বাইরের বিচারক আনার সুযোগ নেই। কিন্তু ডমেস্টিক ট্রাইব্যুনালের নাম কেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হলো সে ব্যাখ্যা তারা দেননি। আমাকে আমার সহকর্মীদেরই অনেকে প্রশ্ন করেছেন, ট্রাইব্যুনাল যদি ডমেস্টিকই হয় তবে নাম এমন কেন? সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্যে তারা এ প্রশ্নের জবাব পাননি।
অপপ্রচারের জবাব ঠিকমতো দিতে না পারলেও মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় বিচার নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে বিতর্ক ও প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন ঠিকই। এমনকি বিচারধীন বিষয়ে মন্তব্য করে একাধিক মন্ত্রীকে ট্রাইব্যুনালে ব্যাখ্যাও দিতে হয়েছে।
আসামিপক্ষের অপপ্রচার ও চক্রান্ত মোকাবিলায় গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী সমন্বয়ে সেল গঠন করার প্রস্তাব ছিল বিভিন্ন মহলের। সরকার সে রকম কোনো উদ্যোগও নেয়নি।
আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপনের েেত্র রাষ্ট্রপক্ষের আরেকটি দুর্বলতা ছিল অভিযোগ প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি দলিল উপস্থাপন না করা। এ েেত্র তাঁদের যুক্তি, ওই সব দলিল সত্যায়িত করিয়ে আনবে কে, সেটা নাকি তাঁরা বুঝে উঠতে পারেননি। বিচার শুরু হওয়ার বছর দুয়েক পরে এসে এমন কথা শুনতে পাই প্রসিকিউটরদের কাছ থেকে। সরকার এ বিষয়টিরও সুরাহা করতে পারেনি।
সরকার ও রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বলতার কারণেই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও কাদের মোলার বিরুদ্ধে মামলায় অনেক সাীকে হাজির করা যায়নি বলে অভিযোগে আছে। সাীদের সুরা দিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাীক্ষ বাছাই করার েেক্ষত্রও দুর্বলতা ছিল বলে ওই এলাকার অনেক মুক্তিযোদ্ধা অভিযোগ করেছেন।
শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি পদপে
প্রসিকিউশনের দুর্বলতার বিষয়টি সরকারের দিক থেকে স্বীকার করা না হলেও একপর্যায়ে দেখা যায়, অ্যাটর্নি জেনারেল ট্রাইব্যুনালে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ শুনানিতে অংশ নিচ্ছেন। অথচ অ্যাটর্নি জেনারেল মর্যাদার চিফ প্রসিকিউটরের তেমন কোনো ভূমিকা চোখে পড়েনি। এছাড়া অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমানকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে প্রসিকিউশনের সমন্বয়ক নিয়োগ করা হয়। অথচ সেখানে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মর্যাদার বেশ কয়েকজন প্রসিকিউটর রয়েছেন। এম কে রহমান দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রসিকিউশনে এমন দুজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়, যা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠে। পরে ওই নিয়োগ স্থগিত করা হয়।
সরকার প্রসিকিউশনের দুর্বলতা কাটাতে কিছু উদ্যোগ নিলেও তাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। জল অনেক ঘোলা হওয়ার পর সরকার তুরিন আফরোজের মতো দক্ষ ও যোগ্য একজনকে প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেয়। যদিও অভিযোগ আছে, তুরিন আফরোজকে নির্বিঘেœ ও শান্তিতে কাজ করতে দেননি তারই অযোগ্য, দলবাজ ও দুর্নীতিপরায়ন কোনো কোনো সহকর্মী। সম্প্রতি অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল পদ থেকে এম কে রহমানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও কমেনি প্রসিকিউশনের সমস্যা। চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু গত এপ্রিলে চিকিৎসার জন্য ছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। ওই মাসেই তিনি দেশে ফেরেন সুস্থ হয়ে। তার অভিযোগ, তিনি কাজে যোগ দিলেও তার যোগদানপত্রের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বাধা দিচ্ছে প্রসিকিউশনেরই একটি অংশ। তার ছুটির সময় ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সৈয়দ হায়দার আলীকে। চিফ প্রসিকিউটর কাজে যোগ দেওয়ার পরও সৈয়দ হায়দার আলী নিজেকে ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে পরিচয় দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

About

AZADUR RAHMAN CHANDAN E-mail : archandan64@gmail.com Date of Birth : November 27, 1964 Profession : Journalist (Working at The Daily Kaler Kantho) Academic Qualification : BScAg (Hons) from Bangladesh Agricultural University Institute : Patuakhali Agricultural College

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *