আজাদুর রহমান চন্দন
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আপিলের রায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমায় মর্মাহত হয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বুধবার আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর তিনি সাংবাদিকদের কাছে নিজের এ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে পরিবর্তনও চেয়েছেন। নিজের বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, ‘আমি একজন ব্যক্তি, সরকারের সদস্য ও নাগরিক হিসাবে সর্বোচ্চ আদালতের যে কোনো আদেশ ও রায়ের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে মানবতাবিরোধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আমরা আশা করি, সেটা না হওয়ায় আমি মর্মাহত।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড হলেও আপিলের রায়ে সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ মামলার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের কোনো দুর্বলতা ছিল কি না জানতে চাইলে আনিসুল হক বলেন, ‘আমি রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি না দেখে কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। তবে প্রসিকিউশন টিমের যা অবস্থা, সেখানে পরিবর্তন আসা উচিৎ।’ তিনি বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালে কিছু কিছু মামলা চলছে, কিছু রায় অপেমাণ আছে। প্রসিকিউশন টিমের যেন কোনো অসুবিধা না হয় এজন্য আমি কোনো পরিবর্তন আনিনি। তবে দ্রুত এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
আইনমন্ত্রীর এ মন্তব্যে অনেক প্রশ্ন ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো মন্ত্রী প্রসিকিউশনে কেন পরিবর্তন আনতে চান? মামলা পরিচালনায় যারা দক্ষতা দেখাতে পারেননি তাদের তিনি সরাতে চান, নাকি নিজের কাছের প্রসিকিউটরদের রেখে যারা অপেক্ষাকৃত ভাল পারফরমেন্স দেখিয়েছেন তাদের? এসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এ কারণে যে, আপিলের রায় পক্ষে না যাওয়ায় মন্ত্রী প্রসিকিউশনে পরিবর্তন আনার তাগিদ বোধ করেছেন। অথচ আপিল বিভাগে এ মামলা পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল। রায় ঘোষণার রাতে টেলিভিশনের টকশোতে দেখা গেল, অ্যাটর্নি জেনারেল উল্টো চিফ প্রসিকিউটরের বয়সজনিত দুর্বলতা তুলে ধরে তার সমালোচনা করলেন। প্রকারান্তরে তিনি চিফ প্রসিকিউটর পদে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিতই দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যে অনেক মিল পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী বা চিফ প্রসিকিউটরের অনেক দুর্বলতা আছে–এটা অনস্বীকার্য। তবে এখন পর্যন্ত তার সম্পর্কে এমন কোনো অভিযোগ উঠেনি যে, ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি কোনো অসততার আশ্রয় নিয়েছেন। অথচ বেশ কয়েকজন প্রসিকিউটর সম্পর্কে এমন অভিযোগ রয়েছে। কোনো কোনো প্রসিকিউটরের ট্রাইব্যুনালে প্রকাশ্যে আসামিপরে সহায়ক ভূমিকা পালনের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমেও এসেছে। আড়ালে প্রসিকিউশনের কৌশল আসামিপক্ষের কাছে ফাঁস করে দেওয়ার অভিযোগও আছে। আর ওই প্রসিকিউটরদের দক্ষতা যে কতখানি তাও জাতি দেখেছে গত কয়েক বছরে। এদের কেউ কেউ অন্য আদালতে গিয়েও নিয়মবহির্ভুতভাবে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের পক্ষে মামলা লড়েছেন, যে তথ্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অথচ এদের নিয়ে মাথা ব্যথা নেই আইনমন্ত্রী বা অ্যাটর্নি জেনারেলের। তাদের যত ক্ষোভ চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের ওপর।
গত ২০ জুন বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিকের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রপক্ষের এক কৌঁসুলি (প্রসিকিউটর) নিয়ম ভঙ্গ করে নিম্ন আদালতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করেছেন। এ ছাড়া দুজনের বিরুদ্ধে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের মামলা থেকে মুক্ত করার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ ও আদালত সূত্রের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত ৩১ মার্চ রাতে রাজধানীর দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার একটি ভবনে অভিযান চালিয়ে র্যাব-৩-এর একটি দল অস্ত্রসহ নয়জনকে আটক করে। গত ১ এপ্রিল ওই নয়জনের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় অস্ত্র আইনে মামলা হয়। ৮ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজের আদালতে ওই নয় আসামির পক্ষে সাতজন আইনজীবীর ওকালতনামা ও জামিনের আবেদন দাখিল করা হয়। আসামিপক্ষের এই সাতজন আইনজীবীর মধ্যে প্রথমজন হলেন ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে কৌঁসুলি মোখলেছুর রহমান (বাদল)। ২৭ এপ্রিল অস্ত্র মামলায় আসামিরা জামিন পান। ওই দিন জামিন আবেদনের শুনানিতে অন্য আইনজীবীদের সঙ্গে মোখলেছুর রহমানও অংশ নেন।’ আইনত সরকারের আইন কর্মকর্তা বা রাষ্ট্রপক্ষেে কৌঁসুলিরা রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করতে পারেন না। এ ছাড়া সরকারের পূর্বানুমতি ছাড়া ফৌজদারি মামলার আসামিদের পক্ষে মামলাও পরিচালনা করতে পারেন না তারা। ওই দৈনিকটি জানায়, সাম্প্রতিক এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কর্মরত প্রসিকিউটরদের অন্য কোনো আদালতে মামলা পরিচালনার নিয়ম নেই। তার পরও একাধিক কৌঁসুলি হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালতে মামলা পরিচালনা করেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মোখলেছুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, আবদুর রহমান হাওলাদার প্রমুখ। গোয়েন্দা প্রতিবেদনটি আগের মাসে আইন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়া ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত মামলা পরিচালনার পাশাপাশি রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মোহাম্মদ আলী, আবদুর রহমান হাওলাদার প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা মামলাও পরিচালনা করেছেন। উদহারণ হিসেবে বলা হয়, ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি সাভার থানার ঝাউচর গ্রামে আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুরের ঘটনায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ৫৩ জনকে আসামি করে সাভার থানায় মামলা হয়। একজন মন্ত্রীর যোগসাজশে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আবদুর রহমান হাওলাদার ওই মামলায় বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের নির্দোষ প্রমাণ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পুলিশকে বাধ্য করেন। আবদুর রহমান আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। অথচ এই প্রসিকিউটরদের বিষয়ে নীরব আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি প্রশ্ন জাগে, সেটি হলো–সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে প্রসিকিউশন যদি ব্যর্থ হতো তাহলে ট্রাইব্যুনাল আসামিকে সর্বোচ্চ সাজা দিল কীভাবে? এ প্রসঙ্গে বলা দরকার সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। এ মামলায় ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষে সূচনা বক্তব্য রেখেছিলেন প্রসিকিউটর সৈয়দ রেজাউর রহমান। ত্রুটি-দুর্বলতা থেকে থাকলে তার দায় প্রধানত বর্তায় এ দুজনের ওপর। চিফ প্রসিকিউটরও দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল চিফ প্রসিকিউটরের ওপর যতখানি খড়্গহস্ত ততখানি নন অন্য দুজনের বেলায়। সন্দেহ দেখা দেয় এখানেই।
আপিল বিভাগ সাঈদীর সাজা কেন কমালো তা পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে বলার উপায় নেই। তবে এটা ঠিক যে, সাঈদীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মামলা চলাকালীনই রাষ্ট্রপক্ষের অনেক সাক্ষীকে নিয়ে নানা কথা উঠে। অনেক সাক্ষীকে ট্রাইব্যুনালে স্যা দেওয়ার জন্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেছে, ভয়ে ওই সাক্ষীরা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দেয়, এমন স্পর্শকাতর মামলার সাক্ষীদের রাষ্ট্র যথাযথ নিরাপত্তা দেয়নি কেন? আবার রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আরেকজন সাক্ষীরও তেমনটি করার কথা ছিল। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সময় ওই এলাকা থেকে অপহৃত হন তিনি। এ নিয়ে আছে নানা গুঞ্জন-সমালোচনা। আর এসব ঘটনার নেপথ্য কাহিনী জানতে মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে পাওয়া গেছে আরো ভয়ানক অভিযোগ। পিরোজপুর আওয়ামী লীগেরই অনেক নেতা ও মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ, সরকারদলীয় স্থানীয় এমপি ছিলেন সাঈদীর খুবই ঘনিষ্ঠ। সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষী বাছাই করার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন তিনি। এমন সব লোককে সাক্ষী বানানো হয় যাদের অনেকেরই আসামিকে সহায়তা করার কথা ছিল।
আইনমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা কি এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখবেন?
জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলার রায় দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষমান থাকা, সরকারি দলের লোকজনকে দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চে ভাঙন ধরানোসহ নানা কারণে এমনিতেই জনমনে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ রয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে। জামায়াতের সঙ্গে সরকারের আঁতাতের গুঞ্জনও আছে। আঁতাতের অভিযোগ সবচেয়ে তীব্র ছিল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায় ঘিরে। তখনো বিষয়টিকে খুব বেশি প্রাধান্য না দিয়ে প্রসিকিউশনের দুর্বলতাকেই সামনে এনেছি। আঁতাতের গুঞ্জনকে এখনো আমলে নিতে চাই না। যে দলের সরকার এত বড় ও স্পর্শকাতর বিচারের উদ্যোগ নিয়ে তা এগিয়ে নিচ্ছে, সেই দল ও সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চাই। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা সর্বোচ্চ আদালত সরকারের মর্জিমাফিক রায় দেবে এমনটি বিশ্বাস করি না, করতে চাই না। কিন্তু মানুষের মনের দুয়ারে তো আর সরকার তালা লাগিয়ে দিতে পারবে না। তাই সরকারের ভূমিকা আরো দায়িত্বশীল হোক এটাই কাম্য।