আজাদুর রহমান চন্দন
‘ধর্মান্ধ ছাত্রদের নিয়ে গোপনে তৈরি হলো আলবদর বাহিনী। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক ও ছাত্রদের গোপনে হত্যার চক্রান্ত করে। শুধু গোপন চক্রান্তই নয়, আলবদর বাহিনী ওই সব হত্যাকাণ্ড সংঘটিতও করেছিল লোকচুর আড়ালে।… জামায়াতে ইসলামীর মতো সংগঠনের ধর্মান্ধ মানুষগুলোকে ধর্ম রার নামে উদ্বুদ্ধ করে তাদের নিয়ে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ গোপনে গঠন করেছিল ওই দল। এদের একান্ত সহযোগিতায় আরো হত্যায় বিষাদক্লিষ্ট হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনুসন্ধান শেষে কথাগুলো লিখেছিলেন মার্কিন সাংবাদিক ও গবেষক রবার্ট পেইন তাঁর ‘ম্যাসাকার’ গ্রন্থে।
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে ১৯৭১ সালে গঠন করা হয়েছিল কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। নিউ ইয়র্ক টাইমসে ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি এক বিশেষ প্রতিবেদনে আলবদর বাহিনীকে উগ্র মুসলিমদের একটি গোপন কমান্ডো ধরনের সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের একটি বিশেষ দল এ বাহিনীকে প্রশিণ দিত এবং পরিচালনা করত। ওই সেনা কর্মকর্তাদের একজন ছিলেন ক্যাপ্টেন তাহির। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ডেস্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ পাওয়া যায়। একটি নোটে লেখা ছিল, ‘ক্যাপ্টেন তাহির, ভেহিকল ফর আলবদর’ এবং ‘ইউজ অব আলবদর’।দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী বাহিনী হিসেবে রাজাকার বাহিনীর বিষয়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল। কিন্তু ওই বাহিনী নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন। মে মাসের ১৫ তারিখে তারা (জামায়াতের মজলিশ-ই শুরা) ইসলামী ছাত্রসংঘ কর্মীদের নিয়ে আলাদা রাজাকার বাহিনী গড়ার প্রস্তাব দেয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রথমে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে। তবে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা প্রস্তাবটি অন্যভাবে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়ে উঠেন। তাদেরই একজন বালুচ রেজিমেন্টের মেজর রিয়াজ হুসেন মালিক। পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত ‘আলবদর’ গ্রন্থের প্রণেতা সালিম মনসুর খালিদকে দেওয়া এক সাাৎকারে তিনি আলবদর বাহিনী গঠনের প্রভাব ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন,
‘The enemies are more in numbers. Insurgents are in formidable strength. We had no communication and surveillance system and supply of arms and ammunition was irregular. Our men were not accustomed to Bengali language and its natural environment because this sort of situation was not included in our training. Under this circumstance, it had become very hard to do the duty of defending motherland. We needed a group of patriotic Bengalese for defending who will be able to help us in protecting Pakistan.
মেজর রিয়াজ হুসেন মালিক আরো বলেন, “আমাদের প্রথম দেড় মাসের অভিজ্ঞতায় রাজাকার বাহিনী একটি ব্যর্থ বাহিনী হিসেবে ধরা পড়ে। তবে আমি দেখলাম যে, আমার সেক্টরে ইসলামী ছাত্র-সংঘের বাঙালি ছাত্ররা বড় নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিরক্ষা, নেতৃত্বদান ও তথ্য গোপন রাখার বিষয়ে গঠনমূলক ভূমিকা রাখছে। এ কারণে আমি হাইকমান্ড থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো অনুমতি না নিয়ে কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই এসব ছাত্রদের আলাদা করলাম। তারা সংখ্যায় ছিল ৪৭ জন। সবাই ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মী। ১৬ মে ১৯৭১ সালে শেরপুরে তাদের সংক্ষিপ্ত সামরিক ট্রেনিং দেওয়া শুরু হলো। এরা এত নিষ্ঠার সঙ্গে ট্রেনিং নিচ্ছিল যে, ২১ মে এক বক্তৃতায় আমি বলি, “আপনাদের মতো সুন্দর চরিত্রের মুজাহিদ সুলভ প্রকৃতির অধিকারী ইসলামের সন্তানদের আলবদর নামে আখ্যায়িত করা উচিত।” মেজর রিয়াদ আরও বলেন, “তখন হঠাৎ আমার মনে বিদ্যুতের মতো এ চিন্তা ঝলক দিয়ে উঠল যে, এই সংগঠনটিকে আলবদর নামে আখ্যায়িত করা হোক। এই নাম এবং কর্মীদের আলাদা সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার অভিজ্ঞতা এতখানি সাফল্যমণ্ডিত হলো যে, দুই-তিন মাসের মধ্যেই গোটা পূর্ব পাকিস্তানে এই নামেই সংঘের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তরুণদের সংগঠিত করা সম্ভব হয়েছিল।” মেজর রিয়াজ উল্লেখ করেছেন, আলবদরের প্রথম কমান্ডার ছিল উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কামরান।
[In first one and half month our experience with Razakar force became a failure. But in my sector I was observing that the Bengali students of Islami Chhatra Shongho were doing their duty of defense, leadership and maintaining secrecy very constructively. Therefore I made the students united separately with a hesitating mind as I had no permission from high command. They were 47 in number and they all were the workers of Islami Chhatro Shongho. On 16th May, 1971 at Sherpur (Mymensingh district) they were a given a short term military training. After being introduced with their devotion and their merit to acquire the war strategies I delivered a speech to them. In midst of my speech I told them spontaneously that children of Islam like you who have such character such merit and such strength should be entitled as Al Badr. Just like lightning I got the idea that I could name the organization as Al Badr. This name and separate training for the students were so effective that within a few months the work of organizing the all students of Islami Chhatro Shongho became accomplished. The first commander of Al Badr was Kamran and he was a student of I.SC.’]
আলবদর বাহিনী গোপনে গঠন করা হলেও বিষয়টি পুরোপুরি গোপন থাকেনি। এটি যে হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর একটি সহযোগী বাহিনী ছিল এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মীদের নিয়েই যে বাহিনীটি গড়া হয় তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনই একটি প্রমাণ ‘East Pakistan Poilice Abstract Intelligence’ on 1971. এতে বলা হয়, ‘1065, Sylhet.- On 15th September, 1971 between 16:00 hours and 18:00 hours, a meeting of the workers of the ICS, Sylhet was held at Sarada Hall, Sylhet town where members of Islami Chhatra Shongho (ICS) delivered speeches urging upon the workers to work hard for the integrity of Pakistan and to join in large number, the training course imparted by the Pakistan Army. These workers after the training will be known as Al Badr Bahini and their duty will be to watch and check the activity of the rebels.‘
জামায়াত ছাড়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দালাল অন্য দলগুলোর আপত্তি থাকায় কৌশলগত কারণে সামরিক কর্তৃপ ও জামায়াতীরা আলবদরকে রাজাকার বাহিনীর শাখা বলতো। এ কৌশলের কথা মেজর সিদ্দিক সালিকের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে উল্লেখ আছে।
একাত্তরে ‘আলবদর ও আলশামস কাজ করত সেনাবাহিনীর ডেথ স্কোয়াড হিসেবে। প্রগতিশীল অধ্যাপক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও চিকিৎসক তথা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য এদের দায়ী করা হয়।’ এ মন্তব্য পাকিস্তানি গবেষক ও কূটনীতিক হুসাইন হাক্কানির। তাঁর ‘পাকিস্তান : বিটুইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, দুটি আধাসামরিক কাউন্টার ইনসারজেন্সি ইউনিট গড়ার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামী এবং বিশেষ করে এর ছাত্রসংগঠনটি ১৯৭১ সালের মে মাসে সামরিক বাহিনীর উদ্যোগে শরিক হয়। জামায়াতের ছাত্রসংগঠন তাদের অনেক কর্মী-সমর্থককে এসব বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করায়। হাক্কানি আরো লিখেছেন, ‘আলবদর ও আলশামস নামে দুটি আলাদা বিশেষ ব্রিগেডও গড়ে তোলা হয়েছিল ওই ছাত্র ক্যাডারদের নিয়ে। আলবদরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল বিশেষ অভিযানের জন্য।
কৌশলগত কারণে আলবদরকে রাজাকার বাহিনীর শাখা বলত পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ও জামায়াতিরা। এ কৌশল অবলম্বনের কারণ উল্লেখ আছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তখনকার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে।
প্রতিষ্ঠা জামালপুরে : ১৯৭১ সালে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী এ বাহিনী প্রথম গঠিত হয় জামালপুরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকেই। ওই সময় দৈনিক সংগ্রামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ এপ্রিল জামালপুরে পাক বাহিনীর পদার্পণের পর পরই তখনকার মোমেনশাহী জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মুহাম্মদ আশরাফ হোসাইনের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। সে বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম ভাগ পর্যন্ত জামালপুরে আলবদর বাহিনী সাতটিরও বেশি ক্যাম্প স্থাপন করে।
আলবদর শিরোমণি নিজামী : লাহোর থেকে প্রকাশিত সাইয়িদ মুতাক্কিউল রহমান ও সালিম মনসুর খালিদের ‘জাব ভুহ নাজিম-ই আলাদি’ (যখন তারা নাজিম-ই আলা ছিলেন) গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ইরানি বংশোদ্ভূত গবেষক সাইয়েদ ওয়ালি রেজা নাসের তাঁর ‘দ্য ভ্যানগার্ড অব দি ইসলামিক রিভলিউশন : দ্য জামায়াতে ইসলামী অব পাকিস্তান’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, একাত্তরে সরকারের অনুপ্রেরণায় ইসলামী ছাত্রসংঘ (আইজেটি) হয়ে ওঠে জামায়াতে ইসলামীর মূল শক্তি। আর্মির সহায়তায় এরা আলবদর ও আলশামস নামে দুটি প্যারামিলিটারি ইউনিট গঠন করে বাঙালি গেরিলাদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য। ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার নাজিম-ই আলা (প্রধান) মতিউর রহমান নিজামী আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করেন।
প্রতি ইউনিটের সদস্যসংখ্যা ৩১৩ : জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর ‘জনতার পার্লামেন্ট’ কলামে ‘বদর দিবস : পাকিস্তান ও আলবদর’ শীর্ষক নিবন্ধে নিজামী নিজেও লিখেছেন, ‘আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে। পাক বাহিনীর সহযোগিতায় এ দেশের ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৩১৩। এই স্মৃতিকে অবলম্বন করে তারাও ৩১৩ জন যুবকের সমন্বয়ে একেকটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ নিজামী আরো বলেন, ‘সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আলবদরের তরুণ যুবকেরা হিন্দুস্তানের অস্তিত্ব খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে।’
বাহিনীপ্রধান মুজাহিদ : একটি কমান্ডো ধরনের গোপন বাহিনী হওয়ায় আলবদর সদস্যদের নাম-পরিচয় গোপন রাখার চেষ্টা করা হতো। এদের নিয়োগসংক্রান্ত কোনো সরকারি গেজেটও প্রকাশিত হয়নি। পত্রপত্রিকায় এদের সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য ছাপা হতো না। তার পরও কয়েকজনের নাম ১৯৭১ সালে পত্রিকায় বেরিয়েছে। সে বছরের ১১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদে প্রকাশিত একটি ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘গতকাল গুজব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি প্রদান করিয়া আলবদর আয়োজিত পথসভায় বক্তৃতা করিতেছেন আলবদর প্রধান জনাব মুজাহিদ’ (বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ)। মুক্তিযুদ্ধকালে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে পাঠানো এক গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, সে বছর ১৭ অক্টোবর রংপুরে ছাত্রসংঘের এক সভায় মুজাহিদ আলবদর বাহিনী গড়তে নির্দেশ দেন দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী আলবদর কমান্ডার খালেক মজুমদার : পচাগলা লাশের দুর্গন্ধ উপেক্ষা করে স্বজনরা যখন তাঁদের হারানোজনদের লাশ শনাক্ত করার চেষ্টা করছিলেন, তখন ক্রোধে উন্মত্ত একদল মুক্তিযোদ্ধা নেমে পড়েন খুনিদের খোঁজে। তাঁরা পেয়েও যান একজনকে, তার নাম আবদুল খালেক মজুমদার। জামায়াতে ইসলামীর তখনকার দপ্তর সম্পাদক এই ঘাতক ছিল আলবদরেরও কমান্ডার। খালেক মজুমদারই বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার অপারেশন ইনচার্জ : একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর ধরা পড়ে আলবদর কমান্ডার খালেক মজুমদার বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছিল। তখন সে জানিয়েছিল, আলবদররাই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জেরার মুখে খালেক জানায়, বুদ্ধিজীবী হত্যার নাটের গুরু চৌধুরী মঈনুদ্দীন। সে সময় দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় সাংবাদিক সেজে থাকা মঈনুদ্দীনই আলবদরদের কিলিং মিশনের অপারেশন ইনচার্জ। এ বিষয়ে সে বছর ২৩ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাকে এবং ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ অবজারভারে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ইত্তেফাকের প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘নরপিশাচ আলবদরের আরেকজন গ্রেপ্তার : অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ঘাটিত’। ‘অ্যাবস্কনডিং আলবদর গ্যাংস্টার’ শিরোনামে বাংলাদেশ অবজারভারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীর সদস্য চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে ঢাকায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অপারেশন-ইনচার্জ হিসেবে উল্লেখ করেছে ধরা পড়া আলবদর রিং লিডার ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মকর্তা আবদুল খালেক।’ ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে চৌধুরী মঈনুদ্দীনের ছবিও ছাপা হয়েছিল।
১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি ‘অ্যা জার্নালিস্ট ইজ লিংকড টু মার্ডার অব বেঙ্গলিজ’ শিরোনামে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, যে বাংলা পত্রিকাটিতে মঈনুদ্দীন কাজ করতেন সেখানকার সহকর্মী রিপোর্টারদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন একজন বন্ধুবৎসল, ভদ্র ও বুদ্ধিমান যুবক হিসেবে। তাঁর চেহারা ছিল আকর্ষণীয়। দাড়ি ছিল সুন্দর করে ছাঁটা। একটি ডানপন্থী মুসলিম রাজনৈতিক দলের নেতার কাছ থেকে আসা টেলিফোন কল রিসিভ করা ছাড়া তাঁর েেত্র অন্য কিছু ব্যতিক্রম ল করা যেত না। কিন্তু গত কয়েক দিনের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ওই কলগুলো ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মঈনুদ্দীনকে শনাক্ত করা হয়েছে উগ্র মুসলিমদের একটি গোপন কমান্ডো ধরনের সংগঠনের প্রধান হিসেবে, যে সংগঠনটি কয়েক শ বাঙালি অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী ও সাংবাদিককে ঢাকার একটি ইটখোলায় নিয়ে হত্যা করেছে।
ব্রিটেনে বসবাসরত তিনজন বাংলাদেশির একাত্তরে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে ১৯৯৫ সালে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে ব্রিটিশ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টোয়েন্টি টোয়েন্টি টেলিভিশন। কয়েক পর্বের এ প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচার করে চ্যানেল ফোর। অভিযুক্ত এই তিন যুদ্ধাপরাধী হলো চৌধুরী মঈনুদ্দীন, আবু সাঈদ ও লুৎফর রহমান। ‘ওয়ার ক্রাইমস ফাইল’ নামের ওই প্রামাণ্যচিত্রে চৌধুরী মঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের তথ্যপ্রমাণ (প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণসহ) তুলে ধরা হয় সেগুলো হলো–১. অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে অপহরণ ও গুম করা, ২. সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ ও গুম করা এবং ৩. সাংবাদিক আতাউস সামাদকে অপহরণের চেষ্টা ইত্যাদি।
বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের প্রধান জল্লাদ : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঘাতক-দালালদের মধ্যে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় ছিল দুজন। এরা হলো চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান। একজন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অপারেশন ইনচার্জ, অন্যজন চিফ এক্সিকিউশনার বা প্রধান জল্লাদ। এই প্রধান জল্লাদই হলো আশরাফুজ্জামান। সে ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সেই সুবাদে আলবদর হাইকমান্ডেরও সদস্য। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামানকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পত্রিকায় তার ছবিসহ সংবাদ ছাপা হয়েছিল। ওই সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের এই জল্লাদকে ধরিয়ে দিন’। যে গাড়িটিতে করে ঘাতকরা বুদ্ধিজীবীদের বধ্যভূমিতে নিয়ে যেত, তার চালক মফিজউদ্দিন ধরা পড়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে প্রধান জল্লাদ হিসেবে আশরাফুজ্জামানের ভূমিকার কথা।
আশরাফুজ্জামানের ৩৫০ নম্বর নাখালপাড়ার বাড়ি থেকে একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করেছিল মুক্তিবাহিনী। ওই ডায়েরির দুটো পৃষ্ঠায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম পাওয়া যায়, যাঁদের মধ্যে আটজনকে হত্যা করা হয়। তাঁরা হলেন–মুনীর চৌধুরী, ড. আবুল খায়ের, গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, রাশীদুল হাসান, ড. ফয়জুল মহী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডা. গোলাম মর্তুজা। এঁদের প্রত্যেককে আশরাফুজ্জামান নিজে গুলি করে হত্যা করেছিল বলে জবানবন্দি দেয় মফিজউদ্দিন। ডায়েরির অন্যান্য পাতায় দালাল বুদ্ধিজীবীদের নামের পাশাপাশি আলবদর হাইকমান্ডের নামের তালিকা ছিল। এতে মঈনুদ্দীন ছাড়াও ছিল কেন্দ্রীয় কমান্ড সদস্য শওকত ইমরান ও ঢাকা শহরপ্রধান শামসুল হকের নাম।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামান পালিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানে। সেখানে রেডিও পাকিস্তানে চাকরি নেয় সে। পরে চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রে। এখনো সেখানেই আছে।
প্রধান সংগঠক কামারুজ্জামান : সে বছরের ১৬ আগস্ট দৈনিক সংগ্রামের এক প্রতিবেদনে তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘ নেতা মুহম্মদ কামারুজ্জামানের পরিচয় প্রকাশিত হয় আলবদরের প্রধান সংগঠক হিসেবে।
খুলনা জেলা কমান্ডার সিদ্দিক জামাল : ১৯৭১ সালের ৫ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রামের এক প্রতিবেদনে আলবদরের খুলনা জেলা কমান্ডার হিসেবে নাম প্রকাশিত হয় সিদ্দিক জামালের। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী আলবদরের খুলনা মহকুমা কমান্ডার ছিল এ কে এম ফারুকী ও আনসার উদ্দীন।
ক্যাম্প কমান্ডার শওকত ইমরান : ধানমণ্ডিতে সিটি নার্সিংহোমে আলবদর বাহিনীর স্থাপিত ক্যাম্পের কমান্ডার ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ নেতা শওকত ইমরান। ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্র“য়ারি দৈনিক বাংলায় তার এ পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়, ‘ঢাকায় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের অন্যতম নেতা শওকত ইমরান গত ১৬ই ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ রয়েছে। কর্তৃপ তাকে খুঁজছে। সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র।’
রাজশাহীর প্রধান আবদুল হাই ফারুকী : ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর বদর দিবস উপলে রাজশাহীর ভুবনমোহন পার্কে ‘আলবদর বাহিনীর বেসামরিক বিভাগ’ এক জনসভার আয়োজন করে। এ বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, সভায় সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় আলবদর বাহিনীপ্রধান আবদুল হাই ফারুকী।
কিশোরগঞ্জের কমান্ডার আমিনুল : কিশোরগঞ্জের তখনকার ছাত্রসংঘ নেতা ও আলবদর কমান্ডার কে এম আমিনুল হকও তাঁর বইয়ে স্বীকার করেছেন, ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়েই তাঁরা আলবদর বাহিনী গঠন করেছিলেন। ‘আমি আলবদর বলছি’ শিরোনামের বইটি তিনি প্রথম প্রকাশ করেন ১৯৮৮ সালের ১৫ আগস্ট। শেষ সংস্করণটি বেরিয়েছে ২০০৮ সালের ১৫ আগস্ট। বইয়ের ৩১ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্য পুরোপুরি নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলি। অষ্টগ্রামের সাবিয়ানগর থেকে কুলিয়ারচর হয়ে কিশোরগঞ্জে এসে সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারপর আমাদের সমমনা বিশেষ করে ছাত্রসংগঠনের সদস্যদের নিয়ে আমি আলবদর বাহিনী গঠন করলাম।’
গাইবান্ধার কমান্ডার লুৎফর রহমান : বদর দিবস উপলে গাইবান্ধায় বদর বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার সম্মেলন হয়। ওই সময় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, সম্মেলন উদ্বোধন করেন মহকুমা কমান্ডার লুৎফর রহমান।