আজাদুর রহমান চন্দন
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করার লক্ষ্যে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগসহ নানাভাবে শত শত কোটি টাকা খরচ করেও ফাঁসির দণ্ড থেকে রেহাই পেলেন না জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী। মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘বাঙালি খান সাহেব’ বা ‘সরদার’ নামে। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এই সদস্য ১৯৭১ সালে ছিলেন চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তিনি আলবদর হাইকমান্ডের তৃতীয় শীর্ষ পদে আসীন হন। একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দুটি অভিযোগে গত ২ জুন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরো আটটি অভিযোগে তাকে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড।
জামায়াতে ইসলামীর প্রধান অর্থ জোগানদার মীর কাসেম আলী এই বিচার বানচাল করতে শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। মীর কাসেম আলী ২০১০ সালের মে মাসে ওয়াশিংটনভিত্তিক কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে লবিস্ট হিসেবে নিয়োগ দেন। কেসিডির সঙ্গে ওই সময় ছয় মাসের জন্য চুক্তি হয় ২৫ মিলিয়ন ডলারের (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৮২ কোটি টাকা)। ওই চুক্তিপত্রের একটি কপি হাতে পাই। চুক্তিপত্রের কপি থেকে দেখা যায়, চুক্তি অনুযায়ী ২৫ মিলিয়ন ডলার অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়েছে মীর কাসেম আলীকে। সিটি ব্যাংক এনএ-এর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ট্রান্সফার পদ্ধতিতে চুক্তির অর্থ কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের হিসাব নম্বরে (৩০৭১৭২৪৮, সুইফ্ট কোড : সিটি ইউএস ৩৩) পাঠানো হয়। প্রয়োজনে আরো ২৫ মিলিয়ন ডলার (১৮২ কোটি টাকা) দিয়ে চুক্তির মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো যাবে বলে চুক্তিপত্রে উল্লেখ ছিল। এ ছাড়া চুক্তির বাইরে মামলা খরচসহ অন্যান্য খরচ বহন করতে আরো অর্থ দেওয়ার কথা কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে। এ নিয়ে ২০১১ সালের ২ জুন কালের কণ্ঠে আমার লেখা একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘যুক্তরাষ্ট্রে ১৮২ কোটি টাকায় লবিস্ট নিয়োগ মীর কাসেমের’ শিরোনামে। এ বিষয়ে মীর কাসেম আলীর বক্তব্য জানতে তখন তার মালিকানাধীন দিগন্ত টেলিভিশনের কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যক্তিগত সহকারী মোতাকাব্বেরের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরে মোতাকাব্বের জানান, এ বিষয়ে মীর কাসেম আলীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে। কাসেম আলীর মোবাইল ফোন নম্বর চাইলে মোতাকাব্বের তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর মীর কাসেম আলীর প থেকে কালের কণ্ঠে কোনো প্রতিবাদও পাঠানো হয়নি। তবে চুক্তির খবর সঠিক নয় বলে তখন নানাভাবে দাবি করেন মীর কাসেম আলী।
মীর কাসেম আলীর পে কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস ২০১২ সাল পর্যন্ত তৎপরতা চালানোর খবর পাওয়া যায় বিদেশি গণমাধ্যম সূত্রে। এ থেকে ধরে নেওয়া যায় প্রতিষ্ঠানটিকে তখন পর্যন্ত কয়েক হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালের ২২ নভেম্বর সেন্ট লুইস পোস্ট-ডিসপাচ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীকে মুক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী লবিস্ট ফার্ম কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। প্রতিষ্ঠানটির পে মীর কাসেম আলীকে ছাড়ানোর তদবিরে নেতৃত্ব দেন মিসৌরির গ্রেগ হার্টলে। তিনি কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের ভাইস চেয়ারম্যান। মার্কিন কংগ্রেস, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং অন্যান্য দেশ যাতে মীর কাসেম আলীকে রা করতে এগিয়ে আসে সে চেষ্টাই করেন হার্টলে। ‘মিসৌরিয়ান ইন কোয়েস্ট টু ফ্রি বাংলাদেশি নিউজপেপার ওনার ফ্রম জেল’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গ্রেগ হার্টলে এরইমধ্যে মীর কাসেম আলীর পে মার্কিন কংগ্রেস, পররাষ্ট্র দপ্তর এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছ থেকে যথেষ্ট সমর্থন জোগাড় করে ফেলেছেন। এ ছাড়া তাঁর কম্পানি এ বিষয়ে সরাসরি আবেদন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী (তখনকার) হিলারি কিনটনের কাছেও।
এ বিষয়ে ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে তখনকার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, জামায়াতের নেতা মীর কাসেম আলী বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজ প্রশ্নবিদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে আড়াই কোটি মার্কিন ডলার দিয়েছেন। এর তথ্য-প্রমাণ সরকারের হাতে আছে। এ বিষয়ে সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জামায়াতের চুক্তির কপি ও টাকা দেওয়ার রসিদ আমাদের হাতে আসছে।’
গত ২৮ মার্চ মীর কাসেম আলীর পে তাঁর ভাই মীর মাসুম আলী এবং মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নকিবুর রহমান নিজামী আবারও কেসিডিসহ আরেক প্রতিষ্ঠান ‘গ্রিবোস্কি গ্লোবাল স্ট্রাটেজিস’কে লবিস্ট নিয়োগ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সম্পর্কে নেতিবাচক ব্যাপক প্রচার চালাতে থাকেন। মীর মাসুম আলী ও নকিবুর রহমান নিজামীর সংগঠন ‘অরগানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস’ এবং ‘হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ চালাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার। তাদের নিয়োগ করা কেসিডি ও গ্রিবোস্কি মার্কিন প্রশাসনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে করা চুক্তিপত্রে বলা হয়েছে, অরগানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের পে প্রাথমিকভাবে ৯০ দিনের জন্য ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে কাজ করবে কেসিডি। এতে অরগানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের পে সই করেছেন জিয়াউল ইসলাম নামের একজন। আর কেসিডির পে সই করেন প্রতিষ্ঠানের কো-চেয়ারম্যান কাই এন্ডারসন। এই চুক্তিপত্রে অরগানাইজেশন ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ২৫২/এ, লেক এভিনিউ, স্টেটেন আইল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক-১০৩০৩। এই ঠিকানায় মীর কাসেম আলীর ভাই মীর মাসুম আলীর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বলে জানা গেছে। এই ঠিকানায় থাকা ‘রোজডেল মীর ডেভেলপমেন্ট’ এবং ‘দিগন্ত মিডিয়া, ইউএসএ’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন মীর মাসুম আলীর নামে করা হয়েছে।
অন্যদিকে হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ গত ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি করে জাস্ট কনসালটিং এলএলসি নামের একটি লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে। এই ফার্মটির পরিবর্তিত নাম গ্রিবোস্কি গ্লোবাল স্ট্রাটেজিস। হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ হচ্ছে নিজামীর ছেলে নকিবুর রহমানের গড়া সংগঠন। নকিবুর আবার মীর মাসুম আলীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র বলে জানা গেছে।
এত কিছু করেও শেষ রা হয়নি ধনকুবের মীর কাসেম আলীর। একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বিভিন্ন ব্যক্তিকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতনের দায়ে ৭২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এই আলবদর কমান্ডারকে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় দেয়। রায়ে দেখা যায়, মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপরে আনা মোট ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এসবের মধ্যে দুটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে আলাদাভাবে মৃত্যুদণ্ড এবং আরো আটটি নির্যাতনের ঘটনায় বিভিন্ন মেয়াদে মোট ৭২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চারটি নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ওই সব অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয় আসামিকে। প্রমাণ হওয়া অভিযোগগুলোর মধ্যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম হত্যাকাণ্ড ও আটটি নির্যাতনের অভিযোগে সর্বসম্মতভাবে সাজা দেওয়া হয়েছে। জসিমের সঙ্গে আরো পাঁচজনকে হত্যার অভিযোগ আনা হলেও শুধু জসিমকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া অন্য একটি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে (রণজিৎ দাস লাথু ও টুনটু সেন রাজু হত্যা) সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে আসামিকে। এই অভিযোগ থেকে মীর কাসেম আলীকে খালাস দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিঞা। অন্য দুই সদস্য কাসেম আলীকে এ অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেন।
রায়ে বলা হয়, যেহেতু আসামিকে দুটি অভিযোগে পৃথকভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাই একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। তাঁর মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এ রায় কার্যকর করতে হবে। একটি কার্যকর হলে অন্য দণ্ড কার্যকর করার প্রয়োজন নেই।
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ২ নম্বর অভিযোগে ২০ বছর; ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে প্রতিটিতে সাত বছর করে; ১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৪ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কারাদণ্ডের েেত্র একটির পর একটি সাজা চলবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়।
পরিকল্পিতভাবে বেছে বেছে হত্যা : রায়ের অভিমতে বলা হয়, অপরাধের ধরন, আসামির অংশগ্রহণ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, আলবদর বাহিনীতে তাঁর অবস্থান বিবেচনায় সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য। তাঁকে শাস্তি দেওয়া হবে ভিকটিমদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রতিফলন। সচেতনভাবে একটির পর একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। ডালিম হোটেলে নির্যাতনের পর কাউকে কাউকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর বেছে বেছে লোককে হত্যা করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে এসব অপরাধ করায় তাঁর সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এসব অপরাধে তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। গতকাল ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান নিজেই সংপ্তি রায় পাঠ করেন।
রায় শুনেই উত্তেজিত আসামি : রায় ঘোষণার আগে ১০টা ৪৪ মিনিটে মীর কাসেম আলীকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। কাঠগড়ায় বসেই তিনি রায় শোনেন। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় নিয়ে রাখা হয়। তিনি পুরো রায় নিবিড়ভাবে শোনেন। সারাণ তিনি ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। তিনি উচ্চস্বরে ট্রাইব্যুনাল ও রায় সম্পর্কে কটূক্তি করেন। এরপর তাঁকে আবার হাজতখানায় নিয়ে রাখা হয়।
মামলার কার্যক্রম : গত ৪ মে মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনাল। রায় ঘোষণা অপেমাণ রাখার প্রায় ছয় মাস পর গতকাল রায় ঘোষণা করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, দেশান্তরে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৪টি অভিযোগ এনেছিল রাষ্ট্রপ। তবে দুটি অভিযোগে রাষ্ট্রপ সাী হাজির করেনি।
হত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটের ১৪টি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন এক নম্বর ট্রাইব্যুনাল। একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর মামলাটি ২ নম্বর ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর স্যাগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপে মোট ২৪ জন সাী ১২টি অভিযোগের বিষয়ে স্যা দেন। অন্যদিকে মীর কাসেম আলীকে নির্দোষ দাবি করে সাফাই স্যা দেন তিনজন।
২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। সেদিন বিকেলেই তাঁকে মতিঝিলে দৈনিক নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তারের পর ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। এরপর থেকে তিনি কারাবন্দি।
যত অভিযোগ প্রমাণিত
নম্বর দুই. এ অভিযোগে বলা হয়, মীর কাসেমের নেতৃত্বে ১৯ নভেম্বর চাকতাই থেকে লুৎফর রহমান ফারুক ও সিরাজকে অপহরণ করে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ন্ত্রিত বাকলি পুলিশ স্টেশনে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয় এবং তাদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। ফারুককে দু-তিন দিন ডালিম হোটেলে নির্যাতনের পর পাঠিয়ে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম কারাগারে। ১৬ ডিসেম্বর ফারুক মুক্তি পান। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কাসেমকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
নম্বর তিন. মীর কাসেমের নেতৃত্বে ২২ বা ২৩ নভেম্বর সকালে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে বাসা থেকে ধরে ডবলমুরিং থানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে ডালিম হোটেলে নিয়ে তাঁকে নির্যাতন করে আলবদর বাহিনী। বিজয়ের পর জাহাঙ্গীর আলম মুক্ত হন ওই হোটেল থেকে। এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মীর কাসেমকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নম্বর চার. চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার আজিজ কলোনির সাইফ উদ্দিন খানকে ধরে ডালিম হোটেলে নেওয়া হয়। সেখানে মীর কাসেমের নেতৃত্বে তাঁকে নির্যাতন করে আলবদররা। ২ কিংবা ৩ ডিসেম্বর সাইফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সাইফ উদ্দিনকে জেলখানায় রক্তাক্ত অবস্থায় খুঁজে পান তাঁর স্ত্রী নূর জাহান বেগম। এই অভিযোগে কাসেমকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নম্বর ছয়. একাত্তরের ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের একটি চায়ের দোকান থেকে হারুন-অর-রশিদকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে চোখ বাঁধা অবস্থায় ঝুলিয়ে রেখে নির্যাতন করা হয়। কয়েক দিন পর হারুনকে নেওয়া হয় সালমা মঞ্জিলে। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি সেখানে আটক ছিলেন। এই অভিযোগে মীর কাসেমকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নম্বর সাত. ২৭ নভেম্বর মাগরিবের নামাজের পর মীর কাসেমের নেতৃত্বে সাত-আট যুবক চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার সানাউল্লাহ চৌধুরী, হাবিবুর রহমান ও ইলিয়াসকে ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করে। সেখানে তাঁদের ওপর নির্যাতন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নানা তথ্য নিত মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী। ডালিম হোটেল থেকে ৬ ও ৯ ডিসেম্বর মুক্তি পান ওই বন্দিরা। তাঁদের সামনে ডালিম হোটেলে অনেক মানুষকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। এই অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নম্বর নয়. ২৯ নভেম্বর সৈয়দ ওসমান, সৈয়দ জামাল উদ্দিন, সৈয়দ কামাল উদ্দিন, সৈয়দ সরোয়ার উদ্দিন, সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া ও সৈয়দ গোলাম রহমানকে অপহরণ করে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডালিম হোটেলে নির্যাতন করা হয়। মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নম্বর দশ. ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রামের নাজিরবাড়ী এলাকা থেকে মীর কাসেমের নির্দেশে মো. জাকারিয়া সালাউদ্দিন, চুট্টু মিয়া, ইস্কান্দার আলম চৌধুরী ও নাজিম উদ্দিনকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। এই অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নম্বর এগারো. একাত্তরে ঈদুল ফিতরের দিন মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনকে অপহরণ করে আলবদর বাহিনী। তাঁকে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সেখানে আরো পাঁচজনকে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা জসিমের লাশের সঙ্গে তাদের লাশও গুম করে আলবদর বাহিনী। এসব হয়েছে মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে। জসিমের সঙ্গে আরো পাঁচজনকে হত্যার অভিযোগ আনা হলেও শুধু জসিমকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
নম্বর বার. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, রণজিত দাস লুথু ও টনটু সেন রাজুকে চট্টগ্রামের হাজির লেন থেকে অপহরণ করে নির্যাতন করে আলবদর বাহিনী। জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে ডালিম হোটেল থেকে কয়েক দিন পর মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু লুথু ও রাজুকে কাসেমের নির্দেশে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। তাঁদের লাশও গুম করে দেওয়া হয়। কাসেমের নির্দেশে আলবদর, আলশামস ও পাকিস্তানি সেনারা ওই এলাকার ২০০-২৫০ বাড়িঘর ও দোকান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী শতাধিক লোককে দেশ ছেড়ে ভারতে যেতে বাধ্য করে। এই অভিযোগে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন ট্রাইব্যুনাল।
নম্বর চৌদ্দ. কোতোয়ালি থানা এলাকা থেকে নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা নির্যাতন করে। ১৬ ডিসেম্বর নাসির উদ্দিনসহ এক-দেড় শ স্থানীয় ব্যক্তি মুক্তি পায় ডালিম হোটেল থেকে। এই অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
যেসব অভিযোগ থেকে খালাস
নম্বর এক. মীর কাসেমের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর কিছু সদস্য ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর সকাল ১০টায় চট্টগ্রামের ওমারুল ইসলাম চৌধুরীকে অপহরণ করে। পরে কয়েক দফায় চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেল ও পাঁচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল এবং একটি চামড়ার গুদামে নিয়ে নির্যাতন করা হয় তাঁকে। এই অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল।
নম্বর পাঁচ. ২৫ নভেম্বর নন্দন কানন এলাকায় প্রাথমিক শিা অফিসের সামনে থেকে কাসেম আলীর নির্দেশে রাজাকার জালাল চৌধুরীর নেতৃত্বে আবদুল জব্বার মেম্বারকে ধরে নিয়ে ডালিম হোটেলে মীর কাসেমের সামনে হাজির করা হয়। সেখানে জব্বার মেম্বারকে ১৭-১৮ দিন চোখ বাঁধা অবস্থায় নির্যাতন করা হয়। এই অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল।
নম্বর আট. কাসেম আলীর নির্দেশে আলবদর বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ২৯ নভেম্বর রাতে চাদগাঁও থানার নূরুল কুদ্দুস, মো. নাসির, নুরুল হাশেমসহ কয়েকজনকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতন করে। এই অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।
নম্বর তেরো. নভেম্বরের শেষ দিকে সুনীল কান্তি বর্ধনকে অপহরণ ও নির্যাতন করা হয়। এই অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।
জামায়াত-আলবদরের কর্মকাণ্ড ছিল ইসলামের চেতনাবিরোধী
জামায়াতে ইসলামী ও এর সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ দাবি করত, তারা ইসলামের মতাদর্শ বিশ্বাস করে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু পবিত্র ধর্ম ইসলাম মানবতার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ সমর্থন করে না। আলবদর বাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে জামায়াতে ইসলামীর নির্দেশে। এটা ইসলামের চেতনাবিরোধী। আলবদর গঠন হয় ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে। এটি ছিল জামায়াতে ইসলামীর নির্দেশ বাস্তবায়নকারী শাখা (অ্যাকশন সেকশন); যারা জামায়াতের নির্দেশে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে; স্বাধীনতাকামী মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন করেছে, হত্যা করেছে। ইসলামে এমন কাজের স্থান নেই। মীর কাসেম আলীর মামলার রায়ে এসব পর্যবেণ দিয়েছেন বিচারক প্যানেল। লেখক মুহিত-উল আলম ও আবু মো. দেলোয়ার হোসেনের বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে পর্যবেণে বলা হয়, আলবদররা ছিল মেধাসম্পন্ন সশস্ত্র রাজনৈতিক ক্যাডার। ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতারা এ বাহিনী গঠন করে এবং কেন্দ্রীয়ভাবে জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণে এ বাহিনী পরিচালিত হয়।
পাকিস্তানি লেখক সেলিম মনসুর খালিদের বই ‘আলবদর’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘আলবদর ও আলশামসের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাঙালি তরুণদের সংখ্যা ২০ হাজারের কাছাকাছি ছিল। তখন (১৯৭১ সাল) ওই যুবকরা পাকিস্তানের ঐক্যের পে কাজ করছিল। আর যখন পাকিস্তানি বাহিনী দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় বাহিনীর গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তখন ওই তরুণরা পাক বাহিনীকে পুরোপুরি সহযোগিতা করে। এমনকি সেনাবাহিনীর সাফল্য এই তরুণদের উপর নির্ভর করেই অর্জিত হচ্ছিল। কেননা সেনাবাহিনীর বিরাট অংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। তারা পূর্ব পাকিস্তানের রাস্তাঘাট ও ভাষা জানত না বা চিনত না। ওই সময়ে এই তরুণরা ইসলামের প্রতি ভালোবাসা ও দেশপ্রেমে উদ্বেলিত হয়ে সামনে এগিয়ে যায় এবং তারা ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসী হামলা প্রতিহত করার জন্য স্বদেশী বাহিনীকে পূর্ণরূপে সাহায্য করে। এরাই ছিল সেই নওজওয়ান, যারা পাক বাহিনীর অগ্রপথিক ছিল। এই তরুণরা (পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীরা), তাদেরকে আপনারা কলি ও কিশলয়ের আকৃতিতে দেখতে পাচ্ছেন।’ এই কথাগুলো তিনি (লেখক সেলিম মনসুর খালিদ) জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী থেকে পেয়েছেন।
পর্যবেণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, মওদুদী যাদের এভাবে প্রশংসা করে লিখেছেন, তারাই এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় নৃসংশতা ও বর্বরতা চালিয়েছে।
অন্যান্য রায়ের মতো এ রায়েও বলা হয়, আলবদর বাহিনী ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ‘ডেথ স্কোয়াড’। একটি শাখার ডেথ স্কোয়াডের প্রধান হিসেবে মীর কাসেম আলী নিরীহ স্বাধীনতাকামী লোকদের ধরে এনে দিনের পর দিন আটকে রেখে নির্যাতন করতেন। তাঁর নির্যাতনের প্রধান কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রামের ডালিম হোটেল। মূলত ডালিম হোটেলের নামটি রায় জুড়ে বারবার স্থান পেয়েছে।
গতকালের রায় ছিল ৩৫০ পৃষ্ঠার। রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, রাষ্ট্রপরে সাীদের স্যা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে স্থাপিত এই নির্যাতন কেন্দ্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব ছিল মীর কাসেম আলীর। প্রমাণিত অভিযোগগুলো থেকে দেখা যায়, কাসেমেরে নেতৃত্বে প্রতিটি নির্যাতনের সঙ্গে এই ডালিম হোটেল সম্পৃক্ত ছিল। ট্রাইব্যুনাল পর্যবেণে বলেন, মামলার অভিযোগ, দোষী সাব্যস্তকরণ ও শাস্তি–তিনটি অংশেই ডালিম হোটেলে নির্যাতনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। নির্যাতনের আটটি অভিযোগে মীর কাসেম দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যার প্রতিটিতে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাকি যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, এই দুটিতেও ডালিম হোটেলে নির্যাতনের বিষয়টি ছিল।
‘কেয়ারি সিন্দাবাদ’ বর্জন
পর্যটন জাহাজ ‘কেয়ারি সিন্দাবাদ’ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত একাত্তরের ঘাতক মীর কাসেম আলীর মালিকানাধীন জানতে পেরে গত ২ জুন অর্ধশতাধিক ভ্রমণকারী ঘৃণাভরে ওই জাহাজ বর্জন করেছেন। এসব ভ্রমণকারী ওই দিন সকালে টেকনাফ থেকে ‘কেয়ারি সিন্দাবাদ’ জাহাজে করেই সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন না টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে চলাচলকারী পর্যটন জাহাজটির মালিক মীর কাসেম আলী।