আজাদুর রহমান চন্দন
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) করার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কামারুজ্জামানের পুনর্বিবেচনার আবেদনের ওপর শুনানি শেষ হয় গতকাল ৫ এপ্রিল রবিবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চে। আজ সোমবার সকালে আপিল বিভাগ পুনর্বিবেচনার আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছেন। কি কারণে আবেদনটি খারিজ করা হলো তা জানা যায়নি। সকাল ৯টা পাঁচ মিনিটে এজলাসে বসেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ আপিল বিভাগের চার বিচারপতি। এক মিনিটের কম সময়ের ব্যবধানে আদেশ দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতি আদেশে বলেন, ‘পিটিশন ডিসমিসড’ (আবেদন খারিজ)। সংক্ষিপ্ত এই আদেশে কোনো ব্যাখ্যা না থাকলেও আগের দিনের শুনানি থেকেই বোঝা যায় কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা রিভিউ আবেদনের নামে মূলত অনুকম্পা চেয়েছিলেন যাতে আসামির সর্বোচ্চ সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
যেসব কারণে রিভিউ আবেদন করা যায় তার কোনোটিই পূরণ করেনি আসামিপক্ষ। আপিল বিভাগের রায়ে তথ্যগত কোনো ভুল থাকলে রিভিউ করা যাবে। কিন্তু এই মামলায় আপিল বিভাগের কোনো ভুল তারা তুলে ধরতে পারেনি। গতকাল পুনর্বিবেচনার আবেদনের ওপর শুনানি করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। শুনানিতে খন্দকার মাহবুব বলেন, আসামির বিরুদ্ধে সোহাগপুর গ্রামে নির্বিচার হত্যার অভিযোগে তিনজন সাক্ষীর বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ওই তিন সাক্ষীর একজন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নন, তিনি ঘটনা অন্যের কাছে শুনেছেন। বাকি দুজনকে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী দাবি করা হলেও তাঁরা কেউ ঘটনার সময় কামারুজ্জামানকে চিনতেন না। স্বাধীনতার পর তাঁরা কামারুজ্জামানকে দেখেছেন। তিনি বলেন, সোহাগপুরের ঘটনায় তিনজন সাক্ষীর জবানবন্দিতে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও তাদের একজন (১১ নম্বর) তার স্বামীকে হত্যার ঘটনা শুনেছেন। অন্য দুজন সাক্ষী (১২ ও ১৩ নম্বর) প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করলেও তারা জেরায় স্বীকার করেছেন, কামারুজ্জামানকে দেখেছেন স্বাধীনতার পর। এ দুজনের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না। খন্দকার মাহবুব এই দাবি করলেও বাস্তবে আইন অনুযায়ী ওই সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালে আসামিকে অপরাধী হিসেবে শনাক্ত করেছেন।
১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ফরিদা আখতার সম্পাদিত ‘মহিলা মুক্তিযোদ্ধা’ বইয়ে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকার আদালতে দাখিল করে খন্দকার মাহবুব বলেন, সেখানে এই সাক্ষী (১৩ নম্বর) কামারুজ্জামানের নাম বলেননি। এই আইনজীবীদের কে বোঝাবে যে, কোনো ব্যক্তির কাছে সাক্ষাৎকারে কিছু না বলে আদালতে বলার মধ্যে আইনের দৃষ্টিতে কোনো ত্রুটি নয়।
আরেক যুক্তিতে খন্দকার মাহবুব বলেন, একাত্তরের মূল অপরাধীদের বঙ্গবন্ধু দায়মুক্তি দিয়েছেন। তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি রাজাকারদের ক্ষমা করেছেন। এরপর মূল আসামিদের সহযোগীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই কামারুজ্জামান অনুকম্পা পেতে পারেন। ওই সময় আদালত বলেন, এ তথ্য সঠিক নয়। বঙ্গবন্ধু সাধারণ রাজাকারদের ক্ষমা করেছেন, অপরাধীদের ক্ষমা করেননি। এ কারণেই ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন করা হয়।
শেষ যুক্তিতে খন্দকার মাহবুব দাবি করেন, ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়াল ছাড়া বিশ্বে আর যে পাঁচটি যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে তাতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল না। আন্তর্জাতিকভাবে যেখানে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি কমিয়ে আনা হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশেও বিষয়টি বিবেচনা করা যায়।
শুনানির পর আদালত থেকে বেরিয়ে কামারুজ্জামানের অন্যতম আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের বলেন, “আজ যে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে তার প্রধান যুক্তি ছিল নতুন একটি এভিডেন্স দিয়েছি। একজন লেখকের লেখা একটি বই এর আগে আপিল বিভাগে উপস্থাপন করা হয়নি। ওই বইয়ে একজন সাক্ষীর বিস্তারিত বর্ণনা আছে। আমরা মনে করি, আমাদের যুক্তিগুলো আপিল বিভাগ বিবেচনা করবেন এবং রিভিউ অ্যালাউ করে কামারুজ্জামান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন।” শিশির মনির কি জানেন না যে, রিভিউ পর্যায়ে নতুন সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির হওয়ার সুযোগ নেই!
Posted on April 6, 2015, 2:25 pm By arbu
No comments yet Categories: জাতীয়