আজাদুর রহমান চন্দন
১৯৭১ সালে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে বেশি ছিল রাজধানী ঢাকায়। নগরীতে সেনাবাহিনীর সার্বক্ষণিক টহল তো ছিলই, তার ওপর নগরবাসীর কাছে আরেক আতঙ্ক ছিল অবাঙালি বিহারিরা। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ভাষায়, ‘প্রায় প্রায়ই গুজবের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে– মোহাম্মদপুর-মিরপুর থেকে বিহারিরা দলে দলে বেরিয়ে পড়ে এদিকপানে আসবে। একটা তাৎক্ষণিক হৈচৈ পড়ে যায় চারপাশে।’ পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী, বিহারি আর স্থানীয় রাজাকার-আলবদরদের হাতে পুরোপুরি নজরবন্দি অবস্থায় ছিল ঢাকায় থেকে যাওয়া বাঙালিরা। এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ– রাত নামলেই ব্ল্যাকআউট, কারফিউ আর বাড়ির দরজায় আতঙ্কজনক কড়ানাড়া, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি। এমন এক অবরুদ্ধ, অন্ধকার, আতঙ্কের নগরীতে একরাশ আলোর ঝলকানি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন একদল মুক্তিপাগল মেধাবী তরুণ বাঙালি। তাঁদের দলের নাম ছিল ক্র্যাক প্লাটুন। অনেকেই বলত ‘বিচ্ছু বাহিনী’। বদি, রুমী, জুয়েল, স্বপন, কামাল, আজাদ, আলম, আলতাফ মাহমুদ… একঝাঁক উজ্জ্বল তারকা নিয়ে গঠিত হয়েছিল সেই বিচ্ছু দল। তাঁদের কেউ নামকরা ছাত্র, কেউ সুরকার, কেউ খেলোয়াড়।
ক্র্যাক প্লাটুন বা বিচ্ছু বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধার সংগঠিত দল, যে দলটি তখন কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিল। এই দলটি গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম) ও এটিএম হায়দার (বীর উত্তম)। এই বাহিনীর সদস্যরা ভারতের মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। আরবান গেরিলা যুদ্ধের জন্য বিশেষায়িতভাবে তৈরি করা হয়েছিল কমান্ডো ধাঁচের দলটি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের (এসএসজি) কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডো ও প্যারাট্রুপার ছিলেন এ টি এম হায়দার। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর তত্ত্বাবধানেই গড়ে ওঠেছিল ক্র্যাক প্লাটুন। বেশির ভাগ গেরিলাকে তিনি নিজেই প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। এই গেরিলা দলটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ‘হিট অ্যান্ড রান’ পদ্ধতিতে অসংখ্য আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাস সঞ্চার করেছিল। বিশেষ করে একাত্তরের আগস্টে ঢাকার বুকে একের পর এক অভিযান চালিয়ে হানাদার বাহিনীর বুকে রীতিমতো কাঁপন ধরিয়েছিল ওই বিচ্ছু বাহিনী।
১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট সন্ধ্যার পর রাজধানীর ফার্মগেটে মিলিটারি চেকপোস্টে পৌনে তিন মিনিটের এক গেরিলা অপারেশনেই পাঁচ খানসেনা ও ছয় রাজাকার খতম হয়েছিল। ওই অপারেশনে ছিলেন ছয় ‘বিচ্ছু’–বদিউল আলম বদি, হাবিবুল আলম, কামরুল হক স্বপন, আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, পুলু ও সামাদ (আব্দুস সামাদ)। এর অগে ১৯ জুলাই ঢাকা শহরে বিদ্যুতের পাঁচটি উপকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের পাঁচটি দল। ১১ আগস্ট বিচ্ছুরা তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভেতরেও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে তাঁরা গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে ঢাকার আকাশে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন অনেকগুলো। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল বিচ্ছুদের। সে লক্ষ্যে ১৯ আগস্ট রাতে দুটি নৌকায় করে রেকি করতে গিয়েছিলেন কাজী কামাল, বদি, জুয়েল, রুমীসহ (শাফী ইমাম) কয়েকজন। সামনের নৌকায় ছিলেন কাজী, বদি ও জুয়েল। পাওয়ার স্টেশনের আশপাশ দেখার সময় তাঁরা পড়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের একটি নৌকার সামনে। পূর্বনির্দেশনা অনুযায়ী অন্যদের স্টেনগান নৌকার পাটাতনে লুকানো থাকলেও বদি তা রাখেননি। স্টেনগানটি ছিল তাঁর কোলের ওপর। সেনাদের দেখেই অস্ত্র তুলে ব্রাশফায়ার করে পুরো ম্যাগাজিন খালি করে দিয়েছিলেন বদি। কয়েকজন সেনা গুলিতে মারা গিয়েছিল, অন্যরা ঝাঁপ দিয়েছিল পানিতে। নৌকাটিও উল্টে গিয়েছিল। বিচ্ছুদের সবচেয়ে বড় ও দুঃসাহসিক অভিযানটি ছিল ২৫ আগস্ট ধানমণ্ডি এলাকায়। দিনের আলোয় দুটি গাড়িতে করে অভিযানে নেমে তাঁরা ধানমণ্ডি ২০ নম্বর রোডে কাউকে না পেয়ে ১৮ নম্বরে গিয়ে আট সেনাকে খতম করেছিলেন। অভিযান শেষে ফেরার পথে ৫ নম্বর রোডের মুখে সেনা কর্ডনে পড়েও সব কজনকে খতম করে নিরাপদে আস্তানায় ফিরেছিলেন তাঁরা। খালেদ মোশাররফের নির্দেশেই বাংলার দুঃসাহসী ওই তরুণরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওইসব অভিযান চালিয়েছিলেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিস্ফোরণ ঘটানোর পর সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে বিষয়টি জানতে পেরে খালেদ মোশাররফ বলেছিলেন, ‘দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল।’ তিনিই প্রথম ওই দলটিকে ক্র্যাক আখ্যা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। একাত্তরের ১৪ আগস্ট ঢাকার আকাশে হঠাৎ বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখে বিব্রত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানিরা। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘ঢাকা শহরের ৪০ মাইলের মধ্যে আমি বেশ কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি পতাকা উড়তে দেখেছি। উপরন্তু, সারা দেশে গ্রামাঞ্চলের উলেখযোগ্য এলাকা রাতের বেলায় থাকে গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণে। ঢাকা ও অন্য বড় বড় শহরই শুধু এখন পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ন্ত্রণে; যদিও এসব স্থানে মাঝে মাঝেই গেরিলারা আক্রমণ চালিয়ে থাকেন।’ ঢাকা শহরে সব অভিযানেই অবশ্য ক্র্যাক প্লাটুনের সব গেরিলা অংশ নেননি। একেক দল একেকটি অপারেশনে অংশ নিয়েছিল। তবে বদি যে কয়টি অপারেশনে অংশ নেন প্রত্যেকটিতে তাঁর অসাধারণ সাহস ও প্রখর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। এ বিষয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের আরেক গেরিলা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক তাঁর এক বইয়ে লিখেছেন, ‘His (Bodi’s) successful participation in major operations should always be remembered by the people of Dhaka city.’ [সূত্র : হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, ব্রেভ অ্যান্ড হার্ট, পৃষ্ঠা ১১৬।] বদির অন্য সহযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণেও ওইসব অভিযানের যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোতে বদির ভূমিকা পাঠ করার সময় জেমস বন্ডের চরিত্রটির কথাই মনে পড়ে।
ঢাকার ৫৭, মনিপুরী পাড়ার বাসিন্দা আব্দুল বারী (মরহুম) ও রওশন আরা খানমের (মরহুম) ছয় ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বদিউল আলম বদি। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার উত্তরপাড়ায়। বদির জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৬ জুন, ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার শিলাসী গ্রামে নানার বাড়িতে। তাঁর নানা সালাম সাহেব নাতির নাম রেখেছিলেন তপন। স্বজনরা ওই নামেই ডাকত তাঁকে। বদি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ (তখন নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান ক্যাডেট কলেজ) থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্টার মার্ক পেয়েছিলেন। ওই কলেজের আইয়ুব হাউজে থাকতেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও খুব ভালো ফল করেছিলেন বদি। তিনি মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিলেন বলেই জানতেন তাঁর বন্ধুদের অনেকে এবং কারো কারো লেখায়ও তা উলেখ আছে। আসলে তথ্যটি সঠিক নয়। তবে তার প্রাপ্ত নম্বর মেধা তালিকায় ঠাঁই পাওয়ার মতোই ছিল। বদি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স বা স্নাতকোত্তার ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে ঢাকা ফিরে আসেন বদি। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছিল বই পড়ার প্রচণ্ড নেশা। ছাত্রাবস্থায়ই ইংরেজি ভাষায় অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন বদি। ক্যাডেট কলেজের ছাত্রাবাসে থাকাবস্থায় মা-বাবাকে যত চিঠি লিখেছেন সবই ইংরেজিতে। কয়েকটি চিঠি দেখেছি, সুন্দর তাঁর হাতের লেখাও। করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পরীক্ষা দিয়ে আসার পর মার্কস-অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, মাও সেতুংয়ের রাজনৈতিক গ্রন্থের পাশাপাশি সমারসেট মম, উইল ডুরান্ট, শেক্সপিয়ারসহ দেশি-বিদেশি কবি-সাহিত্যিক ও মনীষীদের বই পড়া বেড়ে গিয়েছিল তাঁর। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগমুহূর্তে তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অফিসার হিসেবে নিয়োগপত্র হাতে পেয়েছিলেন, কিন্তু যোগ দেননি। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে মরীয়া ছিলেন তিনি। শুরুতে মা রওশন আরা খানম কিছুটা আপত্তি করেছিলেন। এ বিষয়ে বদিউল আলমের ছোট ভাই যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মাহমুদ হাসান বলেন, ‘‘আম্মা প্রথমে কিছুটা আপত্তি করেছিলেন। অব্বা তখন আম্মাকে বললেন, ‘তোমার তো ছয় ছেলে, একজনকে না হয় দেশের জন্য দিয়েই দিলে।’ আম্মা তখন আর আপত্তি করেননি।” মেধাবী ছাত্র বদি অল্পদিনের মধ্যে হয়ে ওঠেন পাকিস্তান বাহিনীর আতঙ্ক। তাদের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায়ও নাম ওঠেছিল বদির। তাঁদের ঢাকার বাসাটি গোলায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল পাকুন্দিয়ায় গ্রামের বাড়িও।
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে মনস্থির করলেও বদির পক্ষে কাজটি ছিল খুবই কঠিন। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় বদির ঘনিষ্ঠতা ছিল এনএসএফের নেতাদের সঙ্গে। ফলে তাঁর ভয় ছিল ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রোষাণলে পড়ার। এনএসএফের নেতৃস্থানীয় কারো কারো সঙ্গে বদির ঘনিষ্ঠতা যদিও রাজনৈতিক বা আদর্শিক কারণে গড়ে উঠেনি। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বদির ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বোনকে মারাত্মক উত্ত্যক্ত করত ছাত্রলীগের কয়েকজন। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়াই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ওই ছাত্রীর। সাহসী ও স্বাধীনচেতা বদি বিষয়টি জানার পর একদিন মোটর বাইকে করে ক্যাম্পাসে গিয়ে অভিযুক্ত কয়েকজনকে মারধর করেন। সেই রাতেই ছাত্রলীগের ছেলেরা সংঘবদ্ধ হয়ে বদিকে বেদম পিটিয়ে চাকু দিয়ে গায়ের বিভিন্ন স্থানে কেটে লবণ লাগিয়ে দিয়েছিল। বেশ কয়েকদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে একদিন বদি তাঁর বন্ধু স্বপনসহ টু টু বোর রাইফেল নিয়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে ছাত্রলীগের সেই ছেলেদের পিটিয়েছিলেন। সম্ভবত লাইসেন্স করা রাইফেলটি ছিল স্বপনের বাবার। ওই ঘটনার পর আত্মরক্ষার জন্য বদি এনএসএফের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে খাতির জমিয়েছিলেন। সেই সুযোগে ছাত্রলীগ বদিকে এনএসএফের ‘গুণ্ডা’ আখ্যা দিয়েছিল। আর সেই বিরোধের কারণেই বদি ভারতে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। তাই বলে থেমে থাকার পাত্র ছিলেন না বদি। একাত্তরের ২৫ মার্চের পর যেদিন কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়েছিল সেদিনই বদি গিয়েছিলেন শহীদুলাহ খান বাদলের (ইংরেজি দৈনিক নিউএজ-এর প্রকাশক) কাছে, সঙ্গে ছিলেন বন্ধু স্বপন ও আরেকজন। বাদলকে উদ্দেশ করে বদি বলেছিলে, ‘listen you, commies (অর্থাৎ communists) সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বল তোমরা, কিন্তু কোথায় বিপ্লব? Let’s go and fight.’ বদির এমন আহ্বানে স্তম্ভিত হয়ে যান বাদল। চোখেমুখে তার অবিশ্বাস। বাদলের দ্বিধা বুঝতে পারেন বদি। পকেট থেকে ব্লেড বের করে নিজের এবং বাদলের কব্জিতে একটু আঁচড় দেন। দুজনের কব্জি থেকেই বের আসে রক্ত। দুই কব্জির রক্ত মিশিয়ে বদি বাদলকে বলেছিলেন, ‘From today, we are blood brothers. Let’s go and fight.’
একাত্তরের ২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হওয়ার সুযোগে বদিউল আলম ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে তাঁর নানার বাড়ি হয়ে কিশোরগঞ্জে পৈতৃক বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শহীদুলাহ খান বাদল, আসফাকুস সামাদ ও মাসুদ ওমর। ২৯ মার্চ তাঁরা কিশোরগঞ্জ গিয়ে পৌঁছান। জয়দেবপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বিদ্রোহী’ বাঙালি সেনারা লড়াই করতে করতে পিছু হটে ওই সময় কিশোরগঞ্জ গিয়ে অবস্থান করছিল। ওই রেজিমেন্টে বদির পরিচিত দুজন কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়াই ছিল বদির লক্ষ্য। যথারীতি ওই দুই সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে তাঁর নিজেদের আগ্রহের কথা জানালে তাঁদের নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় ওই রেজিমেন্টর অধিনায়ক মেজর কেএম শফিউলাহর সঙ্গে। বদিসহ চার তরুণ সিভিলিয়ান হওয়ায় কেএম শফিউলাহ প্রথমে কিছুটা ইতস্তত করছিলেন। কিন্তু বদি নিজেকে প্রাক্তন ক্যাডেট পরিচয় দিয়ে লড়াই করার বিষয়ে দৃঢ়তা দেখালে তাঁদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সায়ীদ আহমেদ লিখেছেন, “গফরগাঁওয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সাথে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও তিনজন ছাত্র মাসুদ ওমর, শহীদুল্লাহ খান বাদল ও আসফাকুস সামাদ (১ম বাংলাদেশ ওয়্যারকোর্সের অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেছিলেন এবং রংপুর জেলার জয়মনিরহাট স্থানে সম্মূখ সমরে ২২ নভেম্বর ১৯৭১ তিনি শাহাদাত বরণ করেন)। বদি ছাড়া বাকিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই বাম রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এবং বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণের কথা ভাবতেন। গফরগাঁও পৌঁছার পর তারা শুনতে পান, ২য় ইস্ট-বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে কিশোরগঞ্জ গিয়ে অবস্থান করছে। এ খবর শুনে তারাও কিশোরগঞ্জে চলে যান। সেখানে ২য় ইস্ট-বেঙ্গলের কাছ থেকে চারজনের জন্য চারটি পয়েন্ট ৩০৩ রাইফেল, ৪০ রাউন্ড গুলি ও ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড সংগ্রহ করে পহেলা এপ্রিলেই তারা ঢাকার আর কে মিশন রোডে আসফাকুস সামাদের বাসায় এসে উঠেন। পরে অস্ত্রগুলো তোষকে মুড়ে তাদের ছাত্রবন্ধু তওহিদ সামাদের (চালক) গাড়িতে করে ধানমণ্ডির ৪ নম্বর রোডে আরেক বন্ধু ওয়াসেফ-এর বাসায় নিয়ে যান এবং সবার অগোচরে ওই বাসার পেছনে মাটির নিচে অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখেন। ঢাকা তখন পাক হানাদার বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এ অবস্থায় পাকবাহিনীর জোর টহল, নিরাপত্তা চৌকি ও অতিতৎপর গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিয়ে টিকাটুলি থেকে এরকম বড় আকারের এতোগুলো অস্ত্র ধানমন্ডিতে স্থানান্তর সত্যিই ভীষণ দুঃসাহসের কাজ ছিলো। এখন ঠান্ডা মাথায় দেখতে গেলে ভাবি, ওই সময়ে এ কাজটি অনেকটাই নির্বুদ্ধিতার প্রমাণও। তবে একমাত্র মুক্তিপাগল বাংলার দামাল ছেলে বলেই এমন দুঃসাধ্য কাজ তাদের করা সম্ভব হয়েছিল। বদিউল আলম ও তার সহযোদ্ধাদের এমন দুঃসাহসিকতা এটি একটি সামান্য উদাহরণ মাত্র। এর পরে ঢাকায় বিভিন্ন জটিল, ভয়াবহ, কৌশলী ও দুঃসাহসিক যেসব অপারেশনে বদিউল আলম অংশ নেন তা ছিল একইসাথে বিষ্ময় ও গর্বের। এসব অপারেশনে শুধু পাক-হানাদাররা পর্যুদস্ত ও পরাস্তই হয়নি, মুক্তিপাগল জনতা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা- সবাইকে দেশ মায়ের জন্য সাহসী পদক্ষেপ নিতে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছে। তার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মুখ থেকে শোনা যায়, ‘দেশের জন্য তার কিছু একটা করতে হবে’–এমন চেতনা ও তাড়না তাকে যুদ্ধে অংশ নিতে প্রেরণা যোগায়।” [সূত্র : মহান মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ্যপূরণের অনন্য দৃষ্টান্ত ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, ফিফটি ইয়ারস অব ক্যাডেট কলেজ এডুকেশন : ফিফটি ইয়ারস অব ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ; ডিসেম্বর ২৫, ২০০৯]
বদির মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে সহযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকের ভাষ্য : ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের নিরীহ জনতার ওপর পাকিস্তান আর্মি ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার পর ২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। সন্ধ্যায় আবার জারি করা হয় কারফিউ। ২৭ মার্চই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার তরুণ শিক্ষার্থী তাদের ভাগ্য জুড়ে দিয়েছিলেন অনিশ্চিত গন্তব্যের সঙ্গে। শহীদুলাহ খান (বাদল), আসফাকুস সামাদ (আসফী), মাসুদ ওমর (মাসুদ) ও বদিউল আলম (বদি) প্রথম চার সেনানী যারা কিশোরগঞ্জে গিয়ে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। ওই চার যুবক প্রথম গিয়েছিলেন ময়মনসিংহে, পরে কিশোরগঞ্জে। তাঁদের ধারণা ছিল কিশোরগঞ্জে বদিদের গ্রামের বাড়ি যেতে পারলেই তাঁরা নিরাপদ। তবে ময়মনসিংহে পৌঁছে তাঁরা জানতে পারেন, সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কিশোরগঞ্জের দিকে এগোচ্ছে। বদিই তাঁর সঙ্গীদের বলেছিলেন যে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তাঁর চেনা দুজন অফিসার আছেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করা। তাঁরা হলেন ক্যাপ্টেন নাসিম ও লেফট্যানেন্ট হেলাল। দুজনই ক্যাডেট কলেজে বদির দু-এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। ওই দুজনের সঙ্গে দেখা করলে নিশ্চিত তাঁরা তাঁদের সঙ্গে নিতে আপত্তি করবেন না। গাজীপুরে সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে প্রচণ্ড লড়াই করতে করতে ময়মনসিংহের দিকে এগোচ্ছিল। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই স্বল্পততম সময়ের মধ্যে হাতে টাকাপয়সা যা ছিল তাই নিয়ে ময়মনসিংহে উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়েছিলেন বদিরা। যাত্রাপথে তাঁদের মাথার ওপর বারবার চক্কর দিচ্ছিল পাকিস্তান বাহিনীর এফ৮৬ স্যাবর ফাইটার প্লেন। হাবিবুল আলমের ভাষ্যমতে, বদিরা ২৯ মার্চ কিশোরগঞ্জ পৌঁছে লেফট্যানেন্ট হেলালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাঁরা নিজেদের আগ্রহের কথা হেলালকে জানিয়ে তাঁর সহায়তা কামনা করলে তিনি সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও মেজর কেএম শফিউলাহর সঙ্গে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেন। শফিউলাহ তাঁদের আগ্রহের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং প্রশংসা করেন। তিনি তখন লেফট্যানেন্ট হেলালকে নির্দেশ দেন ওই চারজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রয়োজনীয় অস্ত্র বিশেষ করে রাইফেল দিতে। পরদিন সকালেই কিশোরগঞ্জ টাউন হলে তাঁদের শপথ পড়ানো হয়। ওই চার তরুণ বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে লড়াই করার শপথ নেন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন শফিউলাহ নিজেই। [সূত্র : ব্রেভ অ্যান্ড হার্ট, পৃষ্ঠা ৪১-৪২।]
বদিউল আলমের পরিবারের সদস্যদের কাছে শুনেছি, ছোটবেলা থেকেই বদি ছিলেন অসম্ভব সাহসী। ছিলেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ক্র্যাকডাউন শুরু হওয়ার পর আত্মীয়দের মধ্যে অনেক বৃদ্ধ-শিশু ও নারীকে নিজের মোটর বাইকে করে ঢাকা শহর থেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। এসব নানা ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগেই পরিচিতজনদের কাছে বদি হয়ে উঠেছিলেন জেমস বন্ডের মতো। তাঁর সেই সাহসী চরিত্রের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন অপারেশনে। আনুষ্ঠানিক সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই ঢাকার বাইরেও কিছু অপরেশন চালান বদি। মধ্য এপ্রিলে বন্ধু আলী আনোয়ার হেলালকে (কিশোরগঞ্জের তখনকার এসডিপিওর ছেলে) নিয়ে বদিউল আলম কিশোরগঞ্জে তারাইল থানার জাওয়ার গ্রামে আত্মীয়র বাড়িতে দু-তিন সপ্তাহ অবস্থান করেছিলেন। ওই সময়েও থেমে থাকেননি অদম্য বদি। সেখানে স্থানীয় রাজাকারদের বিরুদ্ধে অপারেশনে বদি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন এবং রাজাকারদের নিরস্ত্র করেন। সেখানে উলেখযোগ্য অপারেশন ছিল তারাইল থানা আক্রমণ ও অস্ত্র লুট। এতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশক্তি বাড়ে এবং তারা মানসিকভাবেও ভীষণ অনুপ্রাণিত হন। এর পর পাকুন্দিয়ায় পৈতৃক বাড়িতে গেলে বদির মা তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোরা অসংঘবদ্ধ অবস্থায় বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে যা করছিস এতে একদিন যেখানে সেখানে ঠিকানাবিহীনভাবে তোদের মৃতদেহ পড়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে। তোরা যা, যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে হানাদার বাহিনীর মোকাবিলা কর। এভাবে মোকাবিলা করতে গিয়ে আমার ছেলে যদি মারাও যায়, মা হিসেবে আমি গর্ববোধ করব।’ এর পরে বন্ধু হেলালকে নিয়ে বদি গফরগাঁও হয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলেন।
মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সায়ীদ আহমেদ লিখেছেন, “ঢাকায় এসে হেলাল তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভারতে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। তিনি বদিউল আলমকেও ভারতে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু বদি কোনোভাবেই ভারতে যাওয়ার জন্য রাজি হচ্ছিলেন না। কেননা, তাতে তার সে সময়কার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়ার আশঙ্কা ছিল। ধানমন্ডির ৭ নম্বর সড়কের পার্কে ২৭ জুলাই বদিউল ও কামরুল হক (স্বপন)-এর সাথে হেলালের দেখা হয়। তখনও বদিউল জানায়, সে কোনোভাবেই ভারতে যেতে রাজি নয়। সে ঢাকায় থেকেই যুদ্ধ করবে। এরপর হেলাল তার মা ও বোনদের নিয়ে মেঘালয়ের তুরা নামক স্থানে চলে যান। সেখানে মা ও অন্যদের রেখে হেলাল যুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য যান।”
পরে বদিউল আলম ঢাকা শহর ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি দুঃসাসিক অপারেশনে অংশ নেন। এসবের মধ্যে উলেখযোগ্য হলো–৭ আগস্ট ফার্মগেটে পাকিস্তান বাহিনীর চেকপোস্টে অপারেশন, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ১৯ আগস্ট রেকি করতে গিয়ে লড়াই, ২৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ১৮ ও ২০ নম্বর রোডে অপারেশন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক বাংলায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিচ্ছুদের নেপথ্য কাহিনী’। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি প্রকাশিত ত্রয়োদশ পর্বের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘ফার্মগেট অপারেশন : পৌনে তিন মিনিটে শেষ : ১১ জন খতম’। এর আগের পর্বের প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘সামনে লাল ট্রাফিকের সিগনাল : মন্ত্রীর গাড়ীটি দাঁড়িয়ে পড়ল’। ত্রয়োদশ পর্বের প্রতিবেদনে হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ লিখেছেন, ‘গাড়ী থেকে নেকড়ের মতো নিঃশব্দে অথচ ক্ষিপ্র গতিতে নামল পাঁচজন গেরিলা। এক মিনটের মধ্যে তারা পজিশন নিল। চারজনের হাতে স্টেনগান, একজনের হাতে চাইনীজ এসএমজি। অর্ডার হল–ফায়ার। ঘড়ির কাঁটায় পুরো এক মিনিট চলল ব্রাশ ফায়ার। কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে পড়তে লাগলো ঢাকা নগরীর ফার্মগেট চেক পোস্টের রাজাকার ও মিলিটারী পুলিশগুলো। ঠিক এক মিনিট পর কমান্ড দেয়া হল–রিট্রিট। ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে গাড়ীতে উঠে পড়ল গেরিলারা। তারপর সাঁ করে বেরিয়ে গেল সবুজ রংয়ের টয়োটা করোনা গাড়ীটি। পৌনে তিন তিন মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে অপারেশন শেষ। আর এতে মারা গেল হানার বাহিনীর ৫ জন মিলিটারী পুলিশ ও তাদের ৬ জন সহযোগী রাজাকার।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা নগরীতে এই দুঃসাহসিক ও রোমাঞ্চকর তৎপরতার খবরে ঢাকা নগরীর লোকজন বেশ উজ্জীবিত হয়েছিল।’ প্রতিবেদনে উলেখ আছে, ‘এই অপারেশনে মোট ৬ জন গেরিলা অংশ নেয়। এদের একজন হলো সামাদ ভাই। তিনি ছিলেন গাড়ী ড্রাইভিং-এ। বাকী ৫ জন হলো জুয়েল, বদিউজ্জামান (বদিউল আলম), আলম, পুলু ও স্বপন। এরা সবাই ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর। জুয়েল ও বদি পরবর্তীকালে শহীদ হয়। এদের মধ্যে আলমের কাছে ছিল চাইনীজ এসএমজি; বাকী সবাইর হাতে স্টেনগান, জুয়েল ও পুলুর হাতে ছিল এছাড়া একটি ফসফরাস গেনেড ও একটি গেনেড–৩৬। সামাদ ভাইর হাতে ছিল রিভলভার।’
ধানমণ্ডি অপারেশনের কয়েক দিন পরই ঢাকার বেশির ভাগ গেরিলাকে আটক করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কিছু স্থানীয় বিশ্বাসঘাতক দালালের সহায়তায়। প্রথমে ধরা পড়েছিলেন বদিউল আলম। ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিনের ছেলে ফরিদ ছিলেন বদির বন্ধু। বদির জানা ছিল না যে ওই পরিবারটি গোপনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করত। ধানমণ্ডি অপারেশনের পর জালাল উদ্দিনের বাসায় ছিলেন বদি। ২৯ আগস্ট সকালে ওই বাসায় ফরিদ, জাফর আহমেদ ও পারভেজ হাসানদের সঙ্গে তাশ খেলছিলেন বদিউল। খেলার একপর্যায়ে ফরিদ ঘর থেকে বেরিয়ে যায় এবং সাড়ে ১১টার দিকে পাকি সেনাদের নিয়ে ঢুকে। ভেতরে ঢোকার আগেই বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছিল পাকি সেনাদের একটি দল। বদি জানালা টপকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি। দুপুরের দিকে পাকি-হায়েনারা সেখান থেকে শুধু বদিউলকেই ধরে নিয়ে যায়। এরপর দুদিনের মধ্যে একে একে ধরা পড়েন শাফী ইমাম রুমী, আবুল বারক আলভী (শিল্পী), আলতাফ মাহমুদ (সুরকার), জুয়েল (ক্রিকেটার), হাফিজ, চুলু, বেলায়েত, জহির উদ্দিন জালালসহ অনেকেই। রুমীর বাবা শরীফুল আলম ইমাম ও ভাই জামীকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে তাঁরা ছাড়া পান। কিন্তু আর ফেরেননি বদি, রুমী, জুয়েল, আলতাফ মাহমুদসহ অনেকেই। তাঁদের লাশও ফেরত পাওয়া যায়নি। কবে কাকে হত্যা করা হয় সেই তারিখও নির্দিষ্টভাবে জানা সম্ভব হয়নি। বদিউল আলমের সহযোদ্ধা মনু বন্দী ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাশাপাশি সেলে। ঘটনাচক্রে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। মনু পরে বদির ভাইদের জানিয়েছিলেন, পাকি সেনাদের নির্যাতনে বদির একটি হাতের জয়েন্ট খুলে এবং হাড় ভেঙে ঝুলে গিয়েছিল। মনুরও পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। বন্দীশিবিরে পাকি সেনাদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের মুখেও বদি ঠাণ্ডা গলায় বলেছিলেন, ‘আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। You Can Go to Hell।’ বন্দী অবস্থায়ও তিনি এক পাকিসেনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মনু ও বদির ছোট ভাই ফজলুল আলম সেলিম গিয়ে ফরিদকে ধরে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন। তখন ফরিদের স্ত্রী-সন্তানের কান্নাকাটি, প্রাণভিক্ষা চওয়া আর তাদের মাথায় হাত রেখে কসম খেয়ে ফরিদ বদিকে ধরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে তার কোনো হাত না থাকার কথা দাবি করলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৩ সালে সরকার শহীদ বদিউল আলমকে বীরবিক্রম খেতাব দেয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৫০। গেজেটে তাঁর নাম মোহাম্মদ বদি। [সূত্র : প্রথম আলো, ২১ মার্চ ২০১২] শহীদজননী রওশন আরার সেটুকুই ছিল সান্ত্বনা। ২০০৪ সালের ১১ মার্চের গেজেটে (বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত) অবশ্য বদির নাম সংশোধিত আকারে উল্লেখ করা হয়েছে–শহীদ মো: বদিউল আলম (বদি)। মায়ের নামসহ মনিপুরীপাড়ার বাসার ঠিকানাও আছে তাতে। মনিপুরী পাড়ার বাসিন্দাদের দাবি ছিল–এলাকার প্রধান সড়কটি বদির নামে নামকরণ করার। সেই দাবি পূরণ হয়নি। বদির বাবার চাওয়া ছিল গ্রামের জীর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নাম তাঁর শহীদ সন্তানের নামে রাখার। বিনিময়ে বিদ্যালয়টি সংস্কার করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি নিজ অর্থে। তাঁর চাওয়াও অপূর্ণ থেকে যায় আইনি জটিলতায়। মা রওশন আরার একটি বাণিজ্যিক প্লট ছিল বর্তমান সোনারগাঁও হোটেলের পশ্চিমাংশে। জায়গাটি সরকার অধিগ্রহণ করলেও বিনিময়ে রওশন আরা কিছুই পাননি। এরশাদের আমলে একবার শহীদজননী হিসেবে রওশন আরাকে ডিআইটির একটি মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দিতে চেয়েছিল সরকার। রওশন আরা তাতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘ছেলেকে দিয়েছি দেশের জন্য। ছেলের বিনিময়ে কিছু চাই না। নিজের জমির বিনিময়ে জমি পেলে তাতেই ছেলের নামে কিছু করব।’ রওশন আরা সেই জমি আর পাননি, ছেলের নামে কিছু করাও হয়ে ওঠেনি। অবশেষে ২০০৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন এই শহীদজননী।
বদি নেই, তাঁর মা-বাবাও চলে গেছেন বেশ আগেই। তবে বদির অনেক স্মৃতির সামান্য অংশ হয়ে ৫৭, মনিপুরীপাড়ার বাড়ির সামনের পুরনো নারিকেল গাছটি ‘উচ্চ যেথা শির’ নিয়ে কয়েক বছর আগে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল, যেটিতে ছুরি-চাকু দিয়ে টার্গেট প্র্যাকটিস করাতেন বদি তাঁর ছোট ভাইকে। সংস্কারের কুঠারে সে গাছটিও কাটা পড়েছে। বদির মতো তাঁর নামটিও হারিয়ে যেতে বসেছিল। দেশের অধিক সংখ্যক মানুষ নামটির সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয় কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের কল্যাণে। বদিকে নিয়ে তাঁর উপন্যাস ‘আগুনের পরশমণি’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। পরে সেই উপন্যাস অবলম্বনে হুমায়ূন বানান একটি চলচ্চিত্রও। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বদির বিশেষ পরিচিত। বদিউল আলমের ছোট ভাই ফজলুল আলম সেলিম হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজন একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। সে সুবাদে মনিপুরীপাড়ায় বদিদের বাসায় অবাধ যাতায়াতও ছিল হুমায়ূন আহমেদের। সেলিম এক সময় বুয়েটে শিক্ষকতা করতেন। পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তাঁর ছোট দুই ভাই খায়রুল আলম ও মাহমুদ হাসানও থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। খায়রুল আলম যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পাস করা মাহমুদ হাসানও যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত। এই দুজনও ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করা। শহীদজননী রওশন আরা কোনো পদক না পেলেও একজন সত্যিকারের রত্নগর্ভা। সেই আমলে ছেলেদের পড়িয়েছেন ক্যাডেট কলেজে। সবাই উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। মেয়েও থাকেন যুক্তরাজ্যে। এতগুলো সন্তানকে লালন-পালন করার পাশাপাশি নিজেও পড়াশুনা করেছেন। মৃত্যুর আগে তাঁর বড় সন্তানকে নিয়ে একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপিও লিখে গেছেন তিনি। তবে সেটি প্রকাশ করা হয়ে উঠেনি।