আজাদুর রহমান চন্দন
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি অবশেষে কার্যকর করা হয়েছে। আদালতের রায় অনুযায়ী আজ শনিবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে শীর্ষস্থানীয় এই দুই অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বলে আইজি প্রিজন্স জানান। এর মধ্য দিয়ে দেশে প্রথম কোনো মন্ত্রীর ফাঁসি কার্যকর হলো। দুই অপরাধীই ভিন্ন ভিন্ন সরকারের সময় মন্ত্রী ছিলেন। দুজনের মধ্যে একাত্তরের কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর প্রধান মুজাহিদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে এটিই প্রথম ফাঁসি। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এ নিয়ে চারজনের ফাঁসি কার্যকর হলো। ফাঁসি কার্যকর শেষে র্যাব ও পুলিশ প্রহরায় সাকা চৌধুরীর লাশ চট্টগ্রামে এবং মুজাহিদের লাশ ফরিদপুরে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিচার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দম্ভোক্তি প্রকাশকারী দুই মানবতাবিরোধী অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করার আগে কারাগার এলাকায় জড়ো হন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এবং গণজাগরণ মঞ্চের কয়েকজন কর্মী। তাঁরা সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করার দাবিতে স্লোগানও দেন।
এর আগে দুপুরে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন সাকা ও মুজাহিদ। ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে আবেদন জমা দেন তাঁরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় হয়ে সেই আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছে রাতে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাষ্ট্রপতি তাঁদের প্রাণভিার আবেদন নাকচ করে দেন। এর পরপরই কারা কর্তৃপক্ষ দুই অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করে। এর অংশ হিসেবে সাকা ও মুজাহিদের পরিবারের সদস্যদের ডাকা হয় শেষবারের মতো দেখা করার জন্য। রাত সাড়ে ৯টায় সাকা পরিবারের ১৮ জন এবং রাত ১০টা ৫৫ মিনিটে মুজাহিদের পরিবারের ১৩ সদস্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে যান। সাক্ষাৎ শেষে স্বজনরা বেরিয়ে যাওয়ার পরই আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, কারা তত্তাবধায়ক জাহাঙ্গীর কবির, ঢাকার জেলা প্রশাসক মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, দুই ম্যাজিস্ট্রেট ও কারা কর্মকর্তা, পুলিশ, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ফাঁসির মঞ্চে যান। ১২ জন করে সশস্ত্র কারারী দণ্ডিত একেক অপরাধীকে ঘিরে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান। রাত ১২টা ৩৪ মিনিটে কারাগারের ভেতরে ঢুকে চারটি অ্যাম্বুলেন্স।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোলার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এরপর গত ১১ এপ্রিল কার্যকর করা হয় আরেক জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি। গত রাতে কার্যকর করা হলো সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসি।
কারাগারে নির্বাহী আদেশ : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারা কর্তৃপকে নির্দেশ দেওয়া হয় দুই অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করার। সেই নির্দেশ অনুযায়ী রাত ১২টার পর দুজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর আগে গতকাল দুপুরে তাঁদের স্বাস্থ্যগত পরীক্ষাও সম্পন্ন করা হয়।
দণ্ড কার্যকর করতে প্রধান জলাদ ছিলেন শাহজাহান। তাঁর সহযোগী হিসেবে ছিল আবুল, হজরত, মাসুদ, ইকবাল, রাজুসহ ১২ জন।
দুই অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করতে বৃহস্পতিবার বিকেলেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কারা কর্তৃপক্ষ। এর পর থেকেই তাঁদের ফাঁসি কখন কার্যকর করা হচ্ছে তা নিয়ে সারা দেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহ দেখা যায়। কিন্তু দুই অপরাধী রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন কি না, তা নিয়ে কালক্ষেপণ করায় ফাঁসি কার্যকর করতে দেরি হয় কিছুটা। অবশেষে গতকাল দুপুরে ম্যাজিস্ট্রেটদের সামনে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন তাঁরা। পরে সেটি কারা কর্তৃপরে মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর পর রাষ্ট্রপতি সেটি নাকচ করে দেন। রাষ্ট্রপতি ওই আবেদনে এককথায় ‘আবেদন নামঞ্জুর’ লিখে ফেরত পাঠান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। রাষ্ট্রপতির আদেশের কপি লাল খামে করে রাত ১০টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে দেওয়া হয়। এরপর অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ফাঁসি কার্যকর করার আগে থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশ এলাকায় নেওয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা। কারাগার ঘিরে গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা বলয়।
পরিবারের সদস্যদের শেষ সাক্ষাৎ : রাত সাড়ে ৯টায় সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিবারের ১৮ জন কারাগারের ভেতরে যান এবং সাকা চৌধুরীর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন। এর আগে রাত ৯টা ৫ মিনিটে সাকা চৌধুরীর পরিবারের ২৫ সদস্য যান কারা ফটকে। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে সাকার স্ত্রী-সন্তানসহ ১৮ জন ভেতরে যান। প্রায় এক ঘণ্টা সাক্ষাৎ শেষে রাত ১০টা ৫০ মিনিটে তাঁরা বেরিয়ে যান।
সাকা পরিবার বেরিয়ে আসার পর রাত ১০টা ৫৫ মিনিটে মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা কারাগারের ভেতরে যান তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। এর আগে মুজাহিদের পরিবারকে ডেকে পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। খবর পেয়ে মুজাহিদের স্ত্রী তামান্না-ই জাহানের নেতৃত্বে পরিবারের ১৩ সদস্য কারাগারে যান।
রিভিউ আবেদন খারিজ : রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত ১৪ অক্টোবর আবেদন করেন তাঁরা। এ রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে তা খারিজ করে গত বুধবার রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। এরপর রিভিউ খারিজ-সংক্রান্ত রায়ের কপি গত ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় কারাগারে পৌঁছায়। পরে তাঁদের রিভিউ খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার রায় পড়ে শোনায় কারা কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না তা জানতে চাওয়া হয় দুই অপরাধীর কাছে।
দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রাণভিক্ষার আবেদন : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলর নেসার আলম, ডেপুটি জেলর আরিফ হোসেন ও সর্বোত্তম দেওয়ান দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে একটি গাড়িতে করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। তাঁরা সেখানে স্বরাষ্ট্রসচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খানের কাছে দুই অপরাধীর করা প্রাণভিক্ষার আবেদন নিয়ে যান। দুপুর সোয়া ২টার দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে কারাগারে ফিরে যান তাঁরা। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে সেই আবেদন আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ মোহাম্মদ জহিরুল হকের কাছে পাঠানো হয়। আইনসচিব সেখান থেকে আবেদনটি আইনমন্ত্রীর মতামতের জন্য নিয়ে যান গুলশানে আইনমন্ত্রীর বাসায়। ভেটিং শেষে আইন ও স্বরাষ্ট্রসচিব সেটা নিয়ে যান বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে। এরপর রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে তাঁরা বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, রাষ্ট্রপতি আবেদন দুটি নাকচ করে দেন। তবে এ বিষয়ে বঙ্গভবন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। এরপর রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত-সংবলিত চিঠি কারাগারে পৌঁছে দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বঙ্গভবন ও কারা ফটকে সাকা পরিবার : বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে চিঠি নিয়ে বঙ্গভবনে যান সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ও ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। বঙ্গভবনের ফটকের সামনে গাড়িতে বসে ছিলেন ফারহাত কাদের চৌধুরী। ‘পিটিশন টু দ্য অনারেবল প্রেসিডেন্ট ফ্রম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী’ শিরোনামের চিঠিটি নিয়ে হুম্মাম কাদের চৌধুরী যাওয়ার পর তাঁকে মূল ফটকের অভ্যর্থনা কে বসানো হয়। এরপর তাঁকে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতির কাছে সরাসরি কোনো আবেদন করা যায় না। আবেদন গ্রহণ না করায় বিকেল সোয়া ৫টায় তাঁরা যান কারা ফটকে। তাঁরা কারা কর্তৃপরে কাছে সাকা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তাঁদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁরা। এরপর রাতে সাকা পরিবারের সদস্যদের ডেকে পাঠায় কারা কর্তৃপ।
প্রাণভিক্ষার আবেদন : মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। তবে এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘ওই দুজন প্রাণভিক্ষা না চাইলে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর প্রশ্নই উঠত না। তাঁরা আবেদন করেছেন। সেই আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত জানাবেন। রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদকে তাঁদের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজ হওয়ার রায় পড়ে শোনানো হয়। ওই সময় কারা কর্তৃপক্ষ তাঁদের জানায় যে শেষ সুযোগ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। দুই অপরাধীকে আরো জানানো হয়, অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। কিন্তু দুজনই তখন সময় চান। এ বিষয়ে তাঁরা আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে চান। পরদিন আবার কারা কর্মকর্তারা তাঁদের সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট এসেছেন কি না জানতে চান তাঁরা। পরে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁদের সময় দেয়। অবশেষে গতকাল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে তাঁরা প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রপতির কাছে দুই অপরাধী প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না সেটা জানতে আজ সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফ হোসেন ও তানভির আহমেদ। বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটের দিকে তাঁরা বেরিয়ে যান।
বিচার ও আপিলের রায় : মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত ১৬ জুন সংপ্তি রায় দেন আপিল বিভাগ। এ ছাড়া সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। তাঁর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগ গত ২৯ জুলাই সংপ্তি রায় দেন। সাবেক এই দুই মন্ত্রীর আপিল মামলায় আলাদা দিনে রায় দেওয়া হলেও গত ৩০ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ। এর পরদিন মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালের জারি করা মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনায় কারা কর্তৃপক্ষ। জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোলার মামলায় আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী রিভিউ আবেদন করতে ১৫ দিন সময় পায় সংশ্লিষ্ট পক্ষ। এ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিভিউ আবেদন দাখিল করেন মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী। তাঁদের আইনজীবীরা আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদন জমা দেন।
ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মুজাহিদ গ্রেপ্তার হন। একই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি ছিলেন কারাবন্দি।
হরতালে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর ও পোড়ানোর অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর তিন দিন পর ১৯ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি ছিলেন কারাবন্দি।
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে চারটি অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য পাঁচটি অপরাধে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল ৯টি অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে সাজা দিলেও এসবের মধ্যে আটটি অভিযোগ আপিল বিভাগে প্রমাণিত হয়েছে। এসবের মধ্যে চারটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত ২৯ জুলাই রায় দেন আপিল বিভাগ। আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় গত ৩০ সেপ্টেম্বর।
আলী আহসান মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে মুজাহিদ আপিল করলে আপিল বিভাগ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত ১৬ জুন সংপ্তি রায় দেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ। সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে মুজাহিদকে সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল। তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, একটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং একটিতে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এসবের মধ্যে চারটি অভিযোগ আপিল বিভাগে প্রমাণিত হয়।
সাকার সাজা যেসব অপরাধে
নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা (৩ নম্বর অভিযোগ), সুলতানপুরে বণিকপাড়ায় গণহত্যা (৫ নম্বর অভিযোগ), ঊনসত্তরপাড়ায় গণহত্যা (৬ নম্বর অভিযোগ) এবং চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মোজাফফর আহমেদ ও তাঁর ছেলে শেখ আলমগীরকে হত্যার (৮ নম্বর অভিযোগ) দায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয় সাকার। এ ছাড়া মধ্য গহিরার হিন্দুপাড়ায় গণহত্যা (২ নম্বর অভিযোগ) এবং জগৎমলপাড়ায় গণহত্যার (৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ২০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়। সাংবাদিক নিজামউদ্দিনসহ তিনজনকে নির্যাতন (১৭ নম্বর অভিযোগ) এবং সালেহ উদ্দিনকে নির্যাতনের (১৮ নম্বর অভিযোগ) অপরাধে সাকার পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাউজান এলাকার কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের নূতন চন্দ্র সিংহকে মন্দিরে প্রার্থনারত অবস্থায় ধরে নিয়ে নির্যাতন করে পাকিস্তানি সেনারা। পরে সাকা চৌধুরী নিজে গুলি করে নূতন চন্দ্রের মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
সুলতানপুরে বণিকপাড়ায় গণহত্যা : একই দিন দুপুর ১টার দিকে রাউজানের সুলতানপুরের বণিকপাড়ায় সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে নেপাল চন্দ্র ধরসহ চারজনকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর সেখানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ঊনসত্তরপাড়ায় গণহত্যা : হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ এলাকায় থাকবে কি থাকবে না–এ নিয়ে রাউজানের ঊনসত্তরপাড়ায় িিতশ চন্দ্র মহাজনের বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ডাকা হয় শান্তি কমিটির সভা। এলাকার লোকজন সেখানে উপস্থিত হওয়ার পর সাকা চৌধুরীসহ পাকিস্তানি বাহিনী সেখানে হাজির হয়। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী ব্রাশফায়ার করে। এতে চরণ পাল, মন্তোষ মালী, বাবুল মালীসহ ৭০ জনের বেশি ব্যক্তি নিহত হন। তাঁদের মধ্যে ৫০ জনের নাম জানা গেছে। লাশগুলো ওই বাড়িতেই মাটিচাপা দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তাঁর ছেলেকে হত্যা : একাত্তরের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মোজাফফর আহমেদ ও তাঁর ছেলে শেখ আলমগীরকে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড থেকে সাকা বাহিনী ধরে নিয়ে যায় স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে। সাকার প্রত্য মদদে সেখানে নির্যাতন চালিয়ে পিতা-পুত্রকে হত্যা করা হয়।
মধ্য গহিরার হিন্দুপাড়ায় গণহত্যা : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাউজান থানার মধ্য গহিরার হিন্দুপাড়ার লোকজনকে ধরে নিয়ে ডা. মাখন লাল শর্মার বাড়িতে জড়ো করে মাখন লাল শর্মা, পঞ্চবালা শর্মাসহ পাঁচজনকে হত্যা করা হয়। সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ওই হত্যাকাণ্ড চালায় বলে স্যা-প্রমাণ পাওয়া যায়।
জগৎমলপাড়ায় গণহত্যা : সাকা চৌধুরীর সহযোগী আবু মাবুদসহ দুই ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল রাউজানের মধ্য গহিরার জগৎমলপাড়ায় কিরণ বিকাশ চৌধুরীর বাড়িতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের জড়ো করে। শান্তি কমিটির সভা করার নামে সেখানে তাঁদের জড়ো করা হয়। শান্তি কমিটির সভায় যোগ দিলে যদি জীবন বাঁচে–এ আশায় তাঁরা তাতে যোগ দেন। লোক জড়ো হওয়ার পর বিষয়টি জানানো হয় সাকা চৌধুরীকে। কিছুক্ষণ পর সাকা চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে হাজির হন। এরপর সেনারা চালায় ব্রাশফায়ার। ঘটনাস্থলেই তেজেন্দ্র লাল নন্দী, সমির কান্তি চৌধুরী, কিরণ বিকাশ চৌধুরীসহ ৩২ জন নিহত হন। কয়েক দিন পর নিহতদের ওই বাড়ির উঠানেই মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ ছাড়া আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে।
নিজাম উদ্দিনসহ তিনজনকে নির্যাতন : ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম কোতোয়ালী থানার হাজারী লেনের জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পোড়োবাড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, সিরাজ ও ওয়াহেদ ওরফে ঝুনু পাগলাকে অপহরণ করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গুডস হিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দেড় ঘণ্টা শারীরিক নির্যাতন করা হয় তাঁদের। পরে ওই দিন রাত ১১-১২টার দিকে নিজাম উদ্দিন ও সিরাজকে চট্টগ্রাম কারাগারে নিয়ে গিয়ে কারারুদ্ধ করা হয়। সেখানে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত বন্দি ছিলেন তাঁরা।
সালেহ উদ্দিনকে নির্যাতন : সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মো. সালেহ উদ্দিনকে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার মোহরার গ্রাম থেকে অপহরণ করে ১৯৭১ সালের ১৫ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত সাকার গুডস হিলের নির্যাতনকেন্দ্রে (টর্চার সেল) আটক রেখে নির্যাতন চালানো হয়। এ অপরাধে সাকার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
মুজাহিদের সাজা যেসব অপরাধে
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে (৬ নম্বর) মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এ ছাড়া ফরিদপুরের বাকচরে হিন্দুদের হত্যা ও নিপীড়নের অভিযোগে (৭ নম্বর) ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ তা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ফরিদপুরের রণজিৎ কুমার নাথকে আটক রেখে নির্যাতনের অভিযোগে (৩ নম্বর) ট্রাইব্যুনালের দেওয়া পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং নাখালপাড়া সেনাক্যাম্পে আলতাফ মাহমুদ, রুমী, বদি, আজাদ, জুয়েলকে নির্যাতন ও পরে হত্যার অভিযোগে (৬ নম্বর) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়।
সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ (১ নম্বর) থেকে মুজাহিদকে খালাস দেন আপিল বিভাগ। ট্রাইব্যুনাল এই অভিযোগটি বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগের সঙ্গে মিলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন।
বুদ্ধিজীবী হত্যা : মুজাহিদের বিরুদ্ধে ষষ্ঠ অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে সেখানে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর প্রশিণ ক্যাম্প স্থাপন করে সেখান থেকে অপরাধজনক নানা কার্যক্রম চালানো হয়। মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি (পরে সভাপতি) হওয়ায় ওই আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর নেতা হিসেবে সেখানে উপস্থিত পাকিস্তানি সেনা কমকর্তাদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুজাহিদ গণহত্যা, হত্যা, নির্যাতন, দেশান্তর, একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন। মুজাহিদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে আদালত মন্তব্য করেন।
বাকচর গ্রামে গণহত্যা : মুজাহিদের বিরুদ্ধে সপ্তম অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে। সেখানে বীরেন্দ্র সাহা, উপেন সাহা, জগবন্ধু মিস্ত্রি, সত্য রঞ্জন দাশ, নিরোদ বন্ধু মিত্র, প্রফুল মিত্র ও উপেন সাহাকে আটক করা হয়। পরে তাঁদের হত্যা করে বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া রাজাকাররা সুনীল কুমার সাহার কন্যা ঝুমা রানীকে ধর্ষণ করে। অনিল সাহাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।
বাবু নাথকে নির্যাতনের অভিযোগ : মুজাহিদের বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে যেকোনো একদিন ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামটের (রথখোলা) মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের ছেলে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে। এরপর ফরিদপুর পুরনো সার্কিট হাউসে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মুজাহিদ পাকিস্তানি সেনা অফিসার মেজর আকরাম কোরাইশীর সঙ্গে কথা বলার পর বাবু নাথের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর একটি দাঁত ভেঙে ফেলা হয়। নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আবদুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে রাজাকাররা আটকে রাখে। পরে রাতে রণজিৎ নাথ বাবু সেখান থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচান।
আলতাফ, বদি, রুমী, জুয়েল, আজাদকে নির্যাতন ও হত্যা : একাত্তরের ৩০ আগস্ট রাত ৮টায় তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ, পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যান। সেখানে তাঁরা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমী, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাঁদের গালাগাল করেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন, প্রেসিডেন্টের সাধারণ মা ঘোষণার আগেই তাঁদের হত্যা করতে হবে।
দর্প চূর্ণ
২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর, দুপুর সোয়া ১২ টা। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নির্বাচনী আইন সংস্কার বিষয়ে বৈঠক করে বের হচ্ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। সেখানে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ বলেন, বাংলাদেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী নেই, ছিল না। যুদ্ধাপরাধীও নেই। এর প্রায় আট বছর পর মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ আদালত তাঁর ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখলেন। আপিল বিভাগে রায় বহাল, রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজসহ সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে প্রমাণিত হলো মুজাহিদের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা আর অপরাধের কথা। আজ রাতে তাঁকে ঝুলতে হলো ফাঁসির দড়িতে। স্বাধীনতাবিরোধী আর মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবেই মৃত্যু হলো তাঁর। এর মাধ্যমে গুঁড়িয়ে গেল মুজাহিদের সেই দম্ভোক্তি।
স্বাধীনতাবিরোধীদের ভোটাধিকার না দেওয়ার দাবিসংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী নেই, ছিলও না। কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। এটা বানোয়াট ও কল্পনাপ্রসূত।’
সেদিন মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তা মূল্যায়ন করতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছিলেন মুজাহিদ।
ওই দম্ভোক্তির আট বছর পর মুজাহিদ যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয়েছেন। যুদ্ধাপরাধী হয়েই তাঁকে ফাঁসিকাষ্ঠে যেতে হলো।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ চলার সময় আসামির কাঠগড়ায় থেকেও সাকা চৌধুরী প্রতি পদে পদে আদালতকে অবজ্ঞা করতেন। চিৎকার করে করে বিচারকাজে বাধা দিয়েছেন। বিচারক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বা রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী কাউকেই তিনি কটূক্তি করতে ছাড় দেননি। রায়ের চূড়ান্ত অংশে ট্রাইব্যুনাল তাঁর পর্যবেক্ষণে এ কথা বলেছেন।
আদালতের প্রতি সাকা চৌধুরীর অবজ্ঞাসূচক আচরণ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, বিচারকেরা এজলাস ছাড়ার সময়েও তিনি উঠে দাঁড়াতেন না।
ট্রাইব্যুনাল যেদিন রায় ঘোষণা করেন, সেদিনও দেখা যায়, একদিকে বিচারকরেরা রায় পড়ছেন, আরেক দিকে সাকা চৌধুরী হাসতে হাসতে বিচারকদের উদ্দেশে অবজ্ঞা সূচক কথা বলছেন।
রায়ের সঙ্গে পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ২০১২ সালের ১৪ মে আদালতকক্ষের শৃঙ্খলাভঙ্গ এবং চিৎকার করে কথা বলার জন্য সাকা চৌধুরীকে সতর্ক করা হয়েছিল। পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, সরকার তাঁদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করেছেন, কিন্তু সাকা চৌধুরী তাঁদের কখনো কখনো ‘চেয়ারম্যান সাহেব’ বা ‘মেম্বার সাহেব’ বলে ডাকতেন। এই আচরণের মাধ্যমে সাকা চৌধুরীর আদালতকে অবজ্ঞার বিষয়টি স্পষ্ট ফুটে ওঠে।
২০১০ সালের ৩০ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনালে প্রথম হাজিরার দিন থেকেই বিচারকদের সঙ্গে তর্ক শুরু করেন সাকা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি সিটিং মেম্বার অব পার্লামেন্ট। আমাকে কথা বলতে দিতে হবে। বর্তমান সরকার কারজাই সরকার। এই কারজাই সরকারকে মানি না।’
ট্রাইব্যুনালে বিএনপির সমর্থক ও আইনজীবীদের ঢোকা নিয়ে হইচই হলে সাকা চৌধুরী বলেন, ‘প্রয়োজনে ৫০০ কেন, ৫০০০ আইনজীবী আসবে। প্রয়োজনে কারওয়ান বাজার, পল্টন ময়দানে বিচার হবে। আমি সংসদ ভবনেও ক্যাঙ্গারু কোর্ট দেখেছি।’
২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি শুনানির দ্বিতীয় দিনে এজলাসে ঢুকেই সাকা চৌধুরী চিৎকার করে বলেন, নিজেই নিজের পক্ষে লড়বেন। তিনি বলেন, ‘আমি থাকতে আমার আইনজীবী লাগবে কেন?’
সে বছরের ২০ এপ্রিল কারাভ্যান থেকে সাকা চৌধুরীকে পুলিশের ছয়-সাতজন সদস্য কোলে করে এজলাসে আনেন। তিনি কাঠগড়ায় রাখা চেয়ারের সারির ওপর শুয়ে পড়েন। পরে তাঁকে সেফ হোমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চায় প্রসিকিউশন। এ সময় তিনি বলেন, ‘গণ-আদালতে একবার এ অপরাধে বিচার হয়েছে। এক খাসি কতবার কোরবানি দেবেন?’
মুক্তিযুদ্ধের পর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দেশ ছেড়ে পালান। তাঁর দাবি, ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে তিনি দেশে ফেরেন। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর পাল্টে যায় দেশের রাজনৈতিক চালচিত্র। দেশে ফেরার পর তিনি বারবার দল বদলে ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেছেন। একপর্যায়ে স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন সাকা চৌধুরী। সবশেষে তিনি যোগ দেন বিএনপিতে। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারে (২০০১-২০০৬) প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সংসদবিষয়ক উপদেষ্টাও হন। বর্তমানে তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য।
মুক্তিযুদ্ধের পর আলবদর নেতা মুজাহিদ ছিলেন আত্মগোপনে। জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পেলে মুজাহিদসহ অন্য নেতারা সামনে আসেন। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধে জামায়াত। জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া মুজাহিদকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন।