জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থার পেশ করা তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ তৈরি করার জন্য প্রসিকিউশনের যে দলটি কাজ করছিল, এর প্রধান হলেন প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ। তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের পাশাপাশি দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকেও নিষিদ্ধ করার আবেদন জানানোর প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া দলটির মুখপত্র হিসেবে দৈনিক সংগ্রামও নিষিদ্ধ করার আবেদন থাকবে। তুরিন আফরোজ বলেছিলেন, মামলাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মামলার সব বিষয় খুঁটিনাটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যত দ্রুত সম্ভব ফরমাল চার্জ দাখিল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য দিনরাত কাজ চলছে। তবে তা খুবই সতর্কতার সঙ্গে করা হচ্ছে, যাতে কোনো ভুলত্রুটির সুযোগ কেউ নিতে না পারে।
প্রসিকিউটররা যতই সতর্কতার সঙ্গে কাজ করুন না কেন, সংগঠন হিসেবে জামায়াত বা এর ছাত্র সংগঠনের বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আইনের অস্পষ্টতা বা ফাঁক দূর হয়নি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি কী হবে, সে নিয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে। প্রসিকিউশন জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেই যে বিদ্যমান আইনে দলটির শাস্তি নিশ্চিত হবে, তা জোর দিয়ে বলা যায় না।
মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র এবং এসব অপরাধ ঠেকাতে ব্যর্থতার সাতটি অভিযোগে জামায়াতের বিচার করার জন্য ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা গত ২৭ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে প্রসিকিউশনের কাছে। ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা নজির সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। কারণ ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে নাৎসি বাহিনীর বিচারের পর বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালে প্রথমবারের মতো কোনো সংগঠনের বিচার করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো সংগঠনের বিচার শুরু হতে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী নামের সংগঠনের সংশ্লিষ্ট অঙ্গসংগঠনগুলো ও দৈনিক সংগ্রাম বন্ধের কথাও বলা হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের বিচার চাইনি। বিচার চেয়েছি সংগঠন হিসেবে ১৯৭১ সালে জামায়াত যে অপরাধ সংঘটন করেছে, তার। সে সঙ্গে জামায়াতের প্রভাবে যেসব অঙ্গসংগঠন অপরাধ করেছে, তাদেরও বিচার চাওয়া হয়েছে।’ (সূত্র : কালের কণ্ঠ, ২৮ মার্চ, ২০১৪)
এর কিছুদিন আগে তুরিন আফরোজ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্টে ‘ব্যক্তি’র (পারসন) সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কম্পানি, অ্যাসোসিয়েশন বা ব্যক্তিগোষ্ঠীও ‘ব্যক্তি’ বিবেচিত হবে। সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের আইনে ২০ ধারায় উলি্লখিত ‘ব্যক্তির’ মধ্যে সংগঠনও পড়বে। আর ট্রাইব্যুনালের যেকোনো সাজা দেওয়ার ক্ষমতা আইনেই আছে। তিনি যুক্তি দেখান, যাবজ্জীবন, ৯০ বছর বা আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজার কোনো উল্লেখ আইনে নেই; কিন্তু ‘যেকোনো সাজার’ আওতায় ট্রাইব্যুনাল ওই দণ্ড দিয়েছেন। সংগঠনের ক্ষেত্রেও একইভাবে শাস্তি দেওয়া সম্ভব। তবে তুরিন আফরোজ স্বীকার করেন, ‘অপরাধী সংগঠন’ হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলা হলে বিচারের সময় এ বিষয়টি দুই পক্ষের মধ্যে অন্যতম আইনি বিতর্কের সৃষ্টি করবে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে বলে তিনি আশাবাদী। (সূত্র : প্রথম আলো, ২৪ মার্চ, ২০১৪)
তুরিন আফরোজ যতই আশাবাদী হোন না কেন, আইনের এ অস্পষ্টতাটুকু রেখে জামায়াতের বিচার শুরু হলে অনেকেই দুশ্চিন্তায় থাকবেন। এমন তো নয় যে এ অস্পষ্টতা দূর করার সুযোগ নেই বা এটা খুবই কঠিন কাজ। শুধু আইন নয়, সংবিধান সংশোধন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংসদে আছে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের। তাহলে এ আইনি অস্পষ্টতা দূর করার উদ্যোগ নিতে সরকারের বাধা কোথায়?
তুরিন আফরোজ জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্টের পাশাপাশি ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের দৃষ্টান্ত টেনেছেন। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কিন্তু বিতর্কও কম হয়নি। ওই বিচার হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে। সেই বিচারে আসামিপক্ষের আপিলের সুযোগ পর্যন্ত ছিল না। আর আমাদের দেশের আলোচ্য এ বিচার এমনিতেই বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক নানা সংগঠনের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছে। তুরিন আফরোজ আশাবাদী হয়ে নিজেই স্বীকার করেছেন, বিচারের সময় শাস্তির বিষয়টি দুই পক্ষের মধ্যে অন্যতম আইনি বিতর্কের সৃষ্টি করবে।
শুধু বিচারের সময় কেন, এখনই বিষয়টি যথেষ্ট বিতর্ক কি তৈরি করে ফেলেনি? ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক এরই মধ্যে বলেছেন, ‘আইনে দণ্ডের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট না থাকলে বিচারক কাউকে দণ্ড দিতে পারেন না। তবে তিরস্কার করতে পারেন।’ আইন, আদালত ও সংবিধানবিষয়ক প্রতিবেদকদের সংগঠন ল রিপোর্টার্স ফোরামের (এলআরএফ) উদ্যোগে গত ২৩ মার্চ আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন মন্ত্রী। প্রশ্নটি যদিও ছিল আদালত অবমাননার বিষয়ে। তবে মন্ত্রী হওয়ার আগে আনিসুল হক মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের বিচার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-১৯৭৩ সংশোধন করে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বিচারে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধী সংগঠনের শাস্তি কী হবে- এ বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। এ ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হতে পারে।’ ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় তাঁর ওই বক্তব্য ছাপা হয়েছিল।
আইনে সংগঠনের বিচারের বিধান যুক্ত হওয়ার পর গত বছরের ১৮ আগস্ট জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে তদন্ত সংস্থা। এর আগে ১ আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। তিন সদস্যের ওই হাইকোর্ট বেঞ্চের সদস্য বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম সংগঠনের বিচারের ক্ষেত্রে এ-সংক্রান্ত আইনের দুর্বলতা নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ দেন। তাতে বলা হয়, ‘মূল আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীকে বিচারের সম্মুখীন করার বিধান না থাকলেও সম্প্রতি আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত দলকে (organisation) বিচারের সম্মুখীন করার বিধান করা হয়েছে (ধারা-৩)। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে ওই আইনে কোনো দল মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হলে ওই দলকে কী ধরনের দণ্ড এবং সাজা প্রদান করা হবে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। আমার নিঃসংকোচ অভিমত এই যে ওই আইনে মানবতাবিরোধী কোনো দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে, সেই দলের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক দণ্ড আরোপের বা গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিধান করা প্রয়োজন।’ কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আইনে কোনো সংশোধন আসেনি। আর বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান।
এ অবস্থায় প্রসিকিউটররা যত সহজে আশাবাদী হতে পারেন, তত সহজে আশাবাদী হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব কি? যে সমস্যার সহজ সমাধান সরকারের হাতে রয়েছে, সে সমস্যাটিকে জিইয়ে রাখা হলে সংশয়ী হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। সময় কিন্তু এখনো ফুরিয়ে যায়নি। জামায়াতের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ দাখিল করার আগে আইনের অস্পষ্টতাটুকু ঘুচিয়ে ফেলা যায়। রাষ্ট্রপক্ষের দ্বন্দ্বও মিটিয়ে ফেলা জরুরি। এ দুটি বিষয়ে আশু পদক্ষেপ না নেওয়া হলে লাভ জামায়াতের। আর পদক্ষেপ নেওয়া হলে অশুভ ছায়া কেটে ফুটবে আলোর রেখা।