আজাদুর রহমান চন্দন
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী, উসকানিদাতা এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামসের মতো প্যারামিলিটারি গড়ার মূল কারিগর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ১৫ জুলাই এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়েছে, গোলাম আযমকে ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি বিবেচনায় গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য। কিন্তু তাঁর বয়স ৯১ বছর ও শারীরিকভাবে তিনি অসুস্থ। ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হলেও অসুস্থতার কারণে সেদিন থেকেই ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তাঁকে হাসপাতালের প্রিজন সেলে রাখা হয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
মানবতাবিরোধী অপরাধে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মামলার এ রায় ঘোষণার পর পরই এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক, বিশিষ্টজনসহ অনেক সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন সংগঠনকেও তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে স্লোগান উঠেছে- ‘আঁতাতের এই রায় মানি না।’ এ ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ হলো হরতাল।
এর আগে কাদের মোল্লার বিচারের রায় ঘোষণার পরও আঁতাতের অভিযোগ উঠেছিল বিভিন্ন মহলে। সরকারের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ থেকেই তখন ফুঁসে উঠেছিল সারা দেশ। গড়ে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। যদিও সেই মামলা পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষের নানা দুর্বলতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল কালের কণ্ঠের পাতায়। কিন্তু এবার সে সুযোগ নেই। কারণ ট্রাইব্যুনালই বলেছেন, গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রাপ্য। তা সত্ত্বেও বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ট্রাইব্যুনাল তাঁর প্রতি যে উদারতা, মানবিকতা ও অনুকম্পা দেখিয়েছেন, গোলাম আযম কি সত্যিই তা পাওয়ার যোগ্য? ১৯৭১ সালে গোলাম আযম যখন এসব জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করেছিলেন বা তাঁর অধীনদের অপরাধ করতে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন, তখন কি তিনি ভিকটিমদের বয়স বা স্বাস্থ্য বিবেচনা করেছিলেন? এসব প্রশ্ন এখন স্বাভাবিকভাবেই উঠছে। এমনিতেই আমাদের দেশে কদর্য রাজনীতি চর্চার কারণে মানুষের মনে সন্দেহ লেগেই থাকে। সামান্য কারণেই এর প্রকাশও ঘটে। আলোচ্য রায়টি ঘিরেও তেমনি নানা সন্দেহের কথা বলছে নানাজন। কেউ কেউ বলছে, স্থানীয় সরকারের সাম্প্রতিক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে সরকারি দলের জনপ্রিয়তায় যে ভাটার টান স্পষ্ট হয়েছে, তাতে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে সরকার জামায়াতকে কাছে টানার বা নিদেনপক্ষে বিএনপির কাছ থেকে দলটিকে দূরে সরানোর কৌশল হিসেবে এ বিচারেও প্রভাব খাটিয়ে থাকতে পারে। সিপিবি-বাসদের নেতারা এক বিবৃতিতে বলেন, এ রায় জাতিকে চরমভাবে হতাশ করেছে। জাতির কাছে এ রায় গ্রহণযোগ্য নয়। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। শুধু বয়সের কথা বলে এমন জঘন্য অপরাধীর সাজা কমানো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাম মোর্চার এক বিবৃতিতে রায় প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছে, উত্থাপিত অভিযোগগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও সর্বোচ্চ শাস্তির বদলে কারাদণ্ডাদেশ দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ রায় সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার ফল কি না, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
এ রায় নিয়ে জনমনে সৃষ্ট সন্দেহ ও প্রশ্ন যথার্থ, নাকি অমূলক, তা এক কথায় বলা কঠিন। তবে এটাই বাস্তব যে গোলাম আযমকে দেখানো অনুকম্পা মানুষ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি।
ফৌজদারি অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে অপরাধীর বয়স বিবেচনা করার নজির বিভিন্ন দেশে আছে। বাংলাদেশেও অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে তার বয়স বিবেচনা করার বিষয়টি আইনে না থাকলেও সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনায় আছে। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে অপরাধীর বয়স বিবেচনায় নেওয়ার নজির কোনো দেশেই তেমন মেলে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অধীকৃত পোল্যান্ডে নাৎসি বাহিনীর একটি একসটারমিনেশন ক্যাম্পের রক্ষী (গার্ড) ছিলেন ইউক্রেনিয়ান বংশোদ্ভূত জন দেমিয়ানিউক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১১ সালে জার্মানির একটি আদালত যখন দেমিয়ানিউককে মৃত্যুদণ্ড দেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৯১ বছর। এর আগে ইসরায়েলের একটি আদালত তাঁকে শাস্তি দিলেও নাম বিভ্রাটের কারণে আপিলে তিনি পার পেয়ে যান। স্বাধীন ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্রের প্রথম বিচারবিষয়কমন্ত্রী আন্দ্রিইয়া আরতুকভিচকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ১৯৮৬ সালে, যখন তাঁর বয়স ছিল ৮৭ বছর। শুধু তা-ই নয়, আরতুকভিচের স্বাস্থ্য তখন এতটাই খারাপ ছিল যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও, তা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে ১৯৮৮ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি কারা হাসপাতালে মারা যান।
আমাদের সামনে এমন সব নজির যেখানে রয়েছে, সে ক্ষেত্রে গোলাম আযমের বিচারের রায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আর এ রায় ঘোষণার পর রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্লেষকদের কারো কারো মনে বাইরের প্রভাবশালী মহলের ভূমিকার বিষয়টিও প্রশ্নবোধক হয়ে দেখা দেয়। সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর একটি দেশের পদস্থ কর্মকর্তা ঢাকা এসে কয়েক মাস আগে স্পষ্ট বলে গেছেন, তাঁদের দেশেও মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকা সত্ত্বেও এটাকে তাঁরা উৎসাহ দেন না। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে কারো মৃত্যুদণ্ড না হলে ক্ষমতার হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে দণ্ডিত ব্যক্তি ছাড়া পাওয়ার সুযোগ থেকে যাওয়ায় মানুষ গুরুপাপে মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো সাজা মেনে নিতে চায় না। এ অবস্থায় আগামী দিনে যারা ক্ষমতায় আসবেন তাঁদের প্রতি তিনি আহ্বান রেখে যান, যেন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের তাঁরা ছেড়ে না দেন। এ ঘটনা থেকে অবশ্য এমনটি জোর দিয়ে বলা যাবে না যে কূটনৈতিক চাপের কারণেই আদালত প্রভাবিত হয়ে রায় দিয়েছেন। তবে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক নানা তৎপরতা মানুষের চিন্তায় তো ছাপ ফেলবেই। বিশেষ করে এ রায়ের পর সরকারি মহল যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে জনমনে সন্দেহ বেড়েছে বৈ কমেনি।