আজাদুর রহমান চন্দন
বাঙালি ছাড়া দেশের অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষদের পরিচয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে তা মনঃপুত হয়নি অনেকের। ওইসবর জাতিসত্তার মানুষেরা কয়েক বছর যাবৎ নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দাবি করে আসছেন। সিপিবিসহ দেশের বামপন্থী দলগুলোরও সমর্থন রয়েছে এ দাবির প্রতি। কিন্তু ‘আদিবাসী’ শব্দে আপত্তি আছে সরকারের। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ‘নাগরিকত্ব’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–
(১) বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে।
(২) বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।
‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
এই সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার একটি বড় ভুল করলো। দেশের সব মানুষকে ‘জাতি হিসেবে বাঙালি’ বানিয়ে মোটেই ঠিক কাজ করেনি সরকার। আবার বাঙালি ছাড়া দেশের অন্যান্য জাতিসত্তার মানুষদের ‘আদিবাসী’ বলাটাও বাস্তব সম্মত নয়। এতে দেশের বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার খবরদারি কায়েম হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ‘আদিবাসী’ বা ‘ক্ষুদ্রজাতি’ এসব না বলে সরাসরি তাদের জাতি পরিচয় যেমন গারো, হাজং, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি বলা যায় কিংবা সবাইকে একসঙ্গে বোঝানোর বেলায় ভারতের মতো জনজাতি বা তফসিলি জাতি বলা যায়।
২০১১ সালের ২৭ জুন ‘‘কম্পেডিয়াম অন ন্যাশনাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ল’স অ্যান্ড ইন্ডিজেনাস পিপল্স ইন বাংলাদেশ’’ শীর্ষক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, ‘‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০ এর আগে সব সরকারি নথিতে আদিবাসীদের উপজাতি হিসেবে লেখা হতো। ক্ষুদ্রত্ব ও বড়ত্বের ধারণা দেওয়ার কারণে যদিও এই নামটি আমাদের পছন্দ নয়, তথাপি এর মাধ্যমে ‘উপজাতি’ কথাটি ডাস্টবিনে ফেলতে পেরেছি। এখন আবার ওই উপজাতি কথাটিকে সরকার ডাস্টবিন থেকে তুলে আনার চেষ্টা করছে।’’ ইংরেজি ‘ট্রাইব’ শব্দের প্রতিশব্দ ‘উপজাতি’ যথাযথ হয়নি বলেও মনে করেন দেবাশীষ রায়। তিনি বলেন, ভারতের সংবিধানে অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর অর্থে ‘তফসিলি জাতি’ ও ‘জনজাতি’ কথাটির উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশেও সেটি করা যেতে পারে।
আদিবাসী কারা
ইংরেজি indigenous শব্দটির বাংলা হচ্ছে ‘আদিবাসী’। আদিবাসী বলতে জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার হোসে মার্টিনেজ কোবোর যে সংজ্ঞা ১৯৭২ সালে আদিবাসী জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ (Working Group on Indigenous Populations বা WGIP) প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করে, তাতে বলা হয়েছে, Indigenous populations are composed of the existing descendants of the peoples who inhabited the present territory of a country wholly or partially at the time when persons of a different culture or ethnic origin arrived there from other parts of the world, overcame them, by conquest, settlement or other means, reduced them to a non-dominant or colonial condition; who today live more in conformity with their particular social, economic and cultural customs and traditions than with the institutions of the country of which they now form part, under a state structure which incorporates mainly national, social and cultural characteristics of other segments of the population which are predominant.
পরে এ সংজ্ঞার কিছু সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে সংস্থাটি। ১৯৮৩ সালে ডএওচ এ সংজ্ঞার সঙ্গে তিনটি ক্রাইটেরিয়া যোগ করে। এগুলো নিম্নরূপ :
(a) they are the descendants of groups, which were in the territory at the time when other groups of different cultures or ethnic origin arrived there;
(b) precisely because of their isolation from other segments of the country’s population they have almost preserved intact the customs and traditions of their ancestors which are similar to those characterised as indigenous;
(c) they are, even if only formally, placed under a state structure which incorporates national, social and cultural characteristics alien to their own.
১৯৮৬ সালে এর সঙ্গে আরো যোগ করে বলা হয়, any individual who identified himself or herself as indigenous and was accepted by the group or the community as one of its members was to be regarded as an indigenous person.
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা নিয়ে নানা বিতর্কের কারণে DWIG আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণার খসড়া প্রণয়ন করার সময় তাতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কোনো সংজ্ঞা রাখেনি।
অন্যদিকে ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ১৬৯ নং কনভেনশনে আদিবাসী বলতে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীন দেশগুলোর জাতিসমূহ, যারা এই মর্মে আদিবাসী হিসেবে পরিগণিত যে তারা ওই দেশটিতে কিংবা দেশটি যে ভৌগোলিক ভূখণ্ডে অবস্থিত সেখানে রাজ্য বিজয়, কিংবা উপনিবেশ স্থাপন, কিংবা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণকাল থেকে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বংশধর, যারা তাদের আইনসংগত মর্যাদা নির্বিশেষে নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর অংশবিশেষ বা সম্পূর্ণ লালন করে চলেছে।’
দেখা যাচ্ছে, জাতিসংঘ যাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাদের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সহজ ভাষায় তারাই আদিবাসী, যারা– ১. কোনো উপনিবেশ স্থাপনের আগে থেকেই ওই ভূখণ্ডে বাস করছিল এবং ২. যারা ভূখণ্ডে নিজস্ব জাতিসত্তার সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে।
এই সংজ্ঞা অনুসারে আদিবাসীর উদাহরণ হতে পারে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীরা। ওই দেশগুলোর আদিবাসীরা প্রথম থেকেই সেখানে ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক দেশগুলো ভূখণ্ড অধিকার করে নিয়ে নিজেদের সংখ্যাগুরু করে ফেলে। নিজেদের ভূখণ্ডে নিজেরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়া ওই মানুষরাই পরবর্তী সময়ে ওইসব দেশের আদিবাসী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
এই একই যুক্তি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। বাংলাদেশে বাঙালিরা বাইরে থেকে এসে দখল করে নেয়নি। বরং উন্মুক্ত এই ভূখণ্ডে বিভিন্ন জাতির আগমনে ধীরে ধীরে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালির আত্মপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রসীমার সামান্য কিছু অংশে বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের উপস্থিতি থাকলেও বাংলাদেশের প্রায় গোটা ভূখণ্ডের ওপর কখনোই তাদের দখল ছিল না এবং বাঙালিরা কখনোই এই ভূখণ্ড কোনো চাকমা, ত্রিপুরা, হাজং, সাঁওতালদের কাছ থেকে দখল করে রাজত্ব কায়েম করেনি। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.২ শতাংশ মানুষ কখনোই এই ভূখণ্ডের মূল মালিক হিসেবে দাবি করতে পারছে না।
সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে পাহাড়ে বাঙালিদের ইতিহাসের তুলনায় চাকমা এবং অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস অনেক বেশি প্রাচীন। সে ক্ষেত্রে পাহাড়ে এসব পাহাড়িই আদিবাসী, এ বিষয়ে বিতর্ক তোলার অবকাশ খুব কম। কিন্তু এই পাহাড়িরা তো পাহাড়ের আদিবাসী হিসেবে নিজেদের দাবি করছে না। তারা দাবি করছে, বাংলাদেশের সংবিধানে ‘আদিবাসী’ হিসেবে নিজেদের পরিচয় অন্তর্ভুক্ত করতে। আদিবাসী কোনো একটি অঞ্চলের হয় না, আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আদিবাসী বলতে বোঝায় কোনো রাষ্ট্রের প্রথম জনগোষ্ঠীকে। এখন যদি সংবিধান ও রাষ্ট্র পাহাড়ি ও সমতলের কিছু অবাঙালি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করে নেয়, তাহলে রাষ্ট্রের ইতিহাস অনাবশ্যক জটিলতার মুখে পড়বে। আর যদি আঞ্চলিক আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হয়, তাহলে এ রকম আরো নতুন নতুন আদিবাসীর দাবি তৈরি হবে। ‘ঢাকাইয়া’ নামে পরিচিত পুরান ঢাকার লোকজনও নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করতে পারবে।
আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি ও আইএলও কনভেনশন
শব্দ ও ব্যাকরণগত আলোচনায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর এক অংশ এবং বাংলাদেশের সুধী সমাজের কিছু সদস্য ও এনজিওরা আদিবাসী নিয়ে নান কথা বললেও, আইএলও কনভেনশন ১৬৯-এর জটিলতার কথা কোথাও তেমন করে আলোচনা হচ্ছে না। কিন্তু আদিবাসী হিসেবে কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়াটা শুধু একটি শব্দগত স্বীকৃতির বিষয় নয়, এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া আছে।
রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বতন্ত্র স্বীকৃতি দেওয়া হলে, আইএলও কনভেনশন ১৬৯ মানার নৈতিক দায়িত্ব বর্তাবে বাংলাদেশের ওপর। যৌক্তিক কারণেই বাংলাদেশসহ অনেক দেশ এই কনভেনশনে সই করেনি এখনো।
ওই কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৪ এ বলা হয়েছে, Indigenous peoples, in exercising their right to self-determination, have the right to autonomy or self-government in matters relating to their internal and local affairs, as well as ways and means for financing their autonomous functions. এ অনুচ্ছেদ মানতে হলে স্পষ্টতই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলকে এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।
ওই কনভেনশনের ১৫.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, The rights of the peoples concerned to the natural resources pertaining to their lands shall be specially safeguarded. These rights include the right of these peoples to participate in the use, management and conservation of these resources. অর্থাৎ আদিবাসীরা বাস করে এমন কোনো এলাকায় কোনো খনিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেলে সেগুলোর ওপর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আলাদা অধিকার জন্মাবে।
সনদের ৩২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আশপাশের দেশগুলোর একই জনগোষ্ঠীগুলোর লোকজনের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও পরিবেশগত যোগাযোগ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক চুক্তি করতে হবে। এর মানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য কিংবা মিয়ানমারের কোনো অঞ্চলের সঙ্গে আমাদের দেশের বিশেষ জনগোষ্ঠীর অবাধ যোগাযোগের পদ্ধতি বাংলাদেশকে আবিষ্কার করে দিতে হবে।
জাতিসংঘ সম্প্রতি আদিবাসী নিয়ে বিশেষ হৈচৈ করছে। মজার বিষয় হচ্ছে, আদিবাসী ইস্যুটি জাতিসংঘের যেসব সদস্য দেশের জন্য প্রযোজ্য, তারাই এ ব্যাপারে কম আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইউরোপের ২৬টি দেশ, চীন, জাপান, রাশিয়া কেউ এই কনভেনশনে সই করেনি। জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৭০টিই এতে সই করেনি। কানাডার মতো বিশাল দেশও বলেছে, আদিবাসী হিসেবে কাউকে অভিহিত করে আলাদা ভূমি বরাদ্দ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
চিলির গলার কাঁটা
আদিবাসী সনদে যে ২৩টি দেশ সই করেছে তার একটি হচ্ছে চিলি। এ সনদ সই করায় দেশটির একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপেয় পানির উৎস থেকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করতে হয়েছে সম্প্রতি। পাহাড়ি যে ঝরণা থেকে বোতলজাত পানি উৎপন্ন হতো, সেটির নিয়ন্ত্রণ ওই এলাকার আদিবাসীদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছে চিলির সর্বোচ্চ আদালত। আদালত রায়ে উল্লেখ করেছে, আইএলও সনদ ১৬৯ স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ওই অঞ্চলের খনিজ সম্পদের ওপর আদিবাসীদের অধিকারকে স্বীকার করে নিতে হবে চিলির সরকারের। তাই ঝরণার পানি, যা খনিজ সম্পদ হিসেবে বিবেচ্য, সেটি বোতলজাত করার কোনো অধিকার সরকার নিযুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ওরা আদিবাসী নয়
বাঙালির ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। এ জাতির উৎপত্তি ও বিকাশ এ দেশের মাটিকে ঘিরেই। বাংলাদেশে চার হাজার বছরের বেশি প্রাচীন তাম্র (chalcolithik) যুগের সভ্যতার নির্দশন পাওয়া গেছে, যেখানে দ্রাবিড়, তিব্বতী-বর্মী ও অস্ট্রো-এশীয় নরগোষ্ঠীর বাস ছিল বলে ধারণা করা হয়। বঙ্গ বা বাংলা শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে নানরকম ব্যাখ্যা আছে। অনেকে মনে করেন এ নামটি এসে থাকতে পারে দ্রাবিড় ভাষী বং নামক একটি গোষ্ঠী থেকে যারা এ অঞ্চলে আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বসবাস করত। প্রাচীন বাংলার রাজধানী পুণ্ড্রবর্ধনপুর, পাহাড়পুর, জগদল বিহারসহ অঙ্গ, বঙ্গ, কুলিঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্র, গৌড় ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাসরত প্রাচীন জনগোষ্ঠীকে এদেশে আগত আর্যরা ‘অনার্য’ নামে অভিহিত করে। প্রাচীনকালের পরিব্রাজকদের কাছে এরাই ‘পাখির মত কিচির-মিচির ভাষায় কথা বলা’ জনগোষ্ঠী। এরাই এদেশের মূল বাসিন্দা বা আদিবাসী।
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা মঙ্গোলয়েড নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ ওইসব জাতিসত্তার আগমন আরাকান, ত্রিপুরা, মিজোরাম ইত্যাদি অঞ্চল থেকে। চাকমারা যুবরাজ বিজয়গিরির নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে আরাকান ও চট্টগ্রামের একটি অংশ দখল করে নেয়। এদেশের চাকমারা মনে করেন, তারা বিজয়গিরির সেই আরাকান-বিজয়ী সৈন্যদের বংশধর। ১৭১৫ সালে চাকমা রাজা জালাল খাঁ (১৭১৫-১৭২৪) সর্বপ্রথম ১১ মণ কার্পাস তুলা উপহার দিয়ে চট্টগ্রামে মোগল কর্তৃপরে সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। মারমারা ১৭৫৬ সালে আরাকানে আশ্রয় নেয়। ১৭৭৪ সালে রামু, ঈদগড়, মাতামুহুরী এবং ১৮০৪ সালে বান্দরবান শহরে বসতি স্থাপন করে তারা। ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা বোদপায়ার সেনাবাহিনী স্বাধীন আরাকান রাজ্য দখল করলে সেখান থেকে পালিয়ে হাজার হাজার শরণার্থী কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালীতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। এদেশে দ্বিতীয় বৃহৎ উপজাতি সাঁওতালসহ অন্যান্য গোষ্ঠী এদেশে এসেছে সাঁওতাল বিদ্রোহের পর। অনেকে এসেছে ব্রিটিশ আমলে মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে।
জুম্ম জাতি হিসেবে স্বীকৃতির দাবি ছিল কয়েক বছর আগেও
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় ১৯৭২ সালের যে সংসদে, তার সদস্য ছিলেন মানবেন্দ্র লারমা। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের গণজোয়ারের মধ্যেও তিনি পাহাড় থেকে স্বতন্ত্র সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে যখন সংসদে দেশের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়, তখন সেখানে ৩নং অনুচ্ছেদে জাতীয়তা প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ সংবিধানে ওইভাবে জাতীয়তা নির্ধারণের প্রতিবাদ জানিয়ে ওয়াক আউট করেছিলেন মানবেন্দ্র লারমা। অবিস্মরণীয় এই নেতা ১৯৭৩ সালের সংসদেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই জয়লাভ করেছিলেন। সারাক্ষণ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই জনসংহতি সমিতি গঠন করেন, পাহাড়ের ১১টি জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে জুম্ম জাতির রূপরেখা প্রণয়ন করেন এবং জুম্ম জাতির স্বীকৃতি আদায়ের জন্যই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। এমনকি যখন পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করে ফেলার জন্য সামরিক জান্তারা চক্রান্ত করেছে এবং জনসংহতি সমিতি সামরিক শাখা গঠন করেছে, তখনো কোনো অংশ থেকেই ‘আদিবাসী’ হিসেবে কোনো দাবি উঠেনি। পাহাড়িদের বিভিন্ন সংগঠন সেই সময় পাহাড়ি সংগঠন হিসেবেই পরিচালিত হয়েছে, আদিবাসী হিসেবে নয়। গত কয়েক বছর ধরে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর নেতারা। তাঁরা সরে এসেছেন আগের জুম্ম জাতির দাবি থেকে।
সম-অধিকার নাকি অগ্রাধিকার
সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা যে কোনো সভ্য রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। দেশে দেশে যুগে যুগে কমিউনিস্টরা সংখ্যালঘু, সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সোচ্চার থেকেছে। থাকাটাই স্বাবাবিক। তবে ওইসব সংখ্যালঘু, সুবিধাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সম-অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রাম করা আর তাদের বাড়তি অধিকারের দাবি তোলা এক নয়।
বাংলাদেশ তার অবাঙালি সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অধিকার কতটা নিশ্চিত করতে পারছে, সেটাই আসল। আদিবাসী না বলে কি দেশের সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সম-অধিকার নিশ্চিত করা যায় না?
আমার মতে, সর্বশেষ সংশোধিত সংবিধানে ‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন’ কথাটির বদলে ‘বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী জাতি হিসেবে বাঙালি, এছাড়া অন্যান্য জাতিসত্তাও রয়েছে; তবে সব নাগরিকই বাংলাদেশী হিসেবে পরিচিত হবেন’ উল্লেখ করলে বিতর্ক এড়ানো যেত।
ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নেতারাও সবাই আদিবাসী পরিচয় ধারণের জন্য মরীয়া নন। এছাড়া প্রয়োজনে সংবিধানে ওই জাতিসত্তাগুলোর নামও উল্লেখ করা যেতে পারে।