আজাদুর রহমান চন্দন
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত জেলার বড় অংশই হাওর। আর ওসব হাওরে বছরে একটিই মাত্র ফসল হয়, বোরো ধান। কিন্তু গত দুই দশকে গড়ে প্রতি তিন বছরেও একবার পুরো ফসল ঘরে তুলতে পারেননি হাওরের কৃষকরা। টানা কয়েক বছর ফসল মার যাওয়ার পর ২০০৮ সালে হাওরে বোরো ধান কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছিল। এর পরের ৯ বছরের মধ্যে মাত্র দুইবার পুরো ফসল ঘরে তুলতে সক্ষম হয় হাওরের কৃষক। অসময়ে কয়েক দিনের টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে এ বছর ধানগাছে থোড় আসতে না আসতেই কোথাও বাঁধ ভেঙে, কোথাও বাঁধ উপচে পানি ঢুকে তলিয়ে গেছে প্রায় সব হাওর। আগের বছর হাওরে বাঁধ ভেঙে কোথাও পাকা, কোথাও আধাপাকা বোরো ধান নষ্ট হয়েছিল চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখের শুরুতে। সে বছর ৪০ শতাংশের মতো ফসল তুলতে পেরেছিল হাওরের কৃষকরা। ২০১৫ সালে অকালবন্যায় হাওরে ফসল নষ্ট হয়েছিল শতকরা ৪০ ভাগের মতো।
সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া—এ সাত জেলার ৪৮টি উপজেলার ২০ হাজার ২২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে দুই হাজার ৪১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে হাওরাঞ্চল। বছরের অর্ধেক সময় হাওরগুলো বহমান পানিতে ডুবে থাকায় জমিতে পলি জমে তা হয়ে ওঠে উর্বর। শুকনো মৌসুমে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করাসহ পরিকল্পিত উপায়ে চাষ করতে পারলে এবং চৈত্র-বৈশাখে আগাম বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা গেলে এ অঞ্চল থেকে শুধু বোরো থেকেই যে পরিমাণ চাল উত্পাদন করা সম্ভব, তা দিয়ে গোটা দেশের খাদ্য চাহিদার বেশির ভাগ পূরণ করা যেতে পারে।
যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে পর্যটন এলাকা হিসেবেও এই অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে গুরুত্বপূর্ণ। এককালে এই অঞ্চলের হাওর ও নদী থেকে তোলা উত্কৃষ্ট মুক্তা রপ্তানি হতো সুদূর ইউরোপে। মত্স্যসম্পদেরও বিশাল আধার হাওর। হাওরের মিঠা পানির মাছের মতো এমন সুস্বাদু মাছ অন্য কোথাও পাওয়া কঠিন।
এবার কয়েক দিনের ব্যবধানে শত শত হাওরের উঠতি বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর সেখানকার পানি দূষিত হয়ে মারা গেছে মাছ, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী। হাওরে মাছ মরে ভেসে ওঠার ছবি কয়েক দিন ধরে ছাপা হচ্ছে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে।
এ বছর হাওর এলাকায় নদীতে পানির চাপ প্রথম দফায় বাড়ে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে; যদিও সেই পানির চাপ হাওরের বাঁধ ভাঙার মতো ছিল না, তবু পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতিতে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার চন্দ্র সোনারথাল প্রকল্পের ফসল রক্ষা বাঁধের একটি ভাঙা অংশ সময়মতো মেরামত না করায় ওই প্রকল্পের আওতাধীন ১০টির মতো হাওরের উঠতি বোরো ধান তলিয়ে যায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ ১২ ফাল্গুন থেকে পরবর্তী কয়েক দিনে। এরপর ২৯ মার্চ থেকে সিলেট অঞ্চলে শুরু হয় টানা বর্ষণ। প্রবল বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে অস্বাভাবিকভাবে পানি বেড়ে যায় হাওর এলাকার নদ-নদীর। ওই পানির চাপে কোথাও বাঁধ ভেঙে আবার কোথাও বাঁধ উপচে পানি ঢুকে গত ৪ এপ্রিল থেকে ফসল তলিয়ে যেতে থাকে একের পর এক হাওরের।
ধান, মাছ, পাখি ও পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনাময় হাওরাঞ্চলের দিকে এতকাল সামান্যই নজর পড়েছে জাতীয় নীতিনির্ধারকদের। নজর যেটুকু পড়েছে তা শুধু হাওরে বেড়িবাঁধ ও ডুবোসড়ক নির্মাণের দিকেই। প্রতিবছর কয়েক শ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় হাওরে বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কারের জন্য; কিন্তু তাতে কাজের কাজ তেমন হয় না।
একটা সময় পর্যন্ত নদী খননের কথা উঠলেই জাতীয় নীতিনির্ধারকরা ব্যয়বহুল আখ্যা দিয়ে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতেন। অথচ এটা না করায় খননজনিত খরচের চেয়ে কত বেশি লোকসান বা ক্ষতি হচ্ছে সে হিসাব খতিয়ে দেখা হয়নি। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলোও নদী খননের মতো প্রকল্প হাতে নিতে নিরুৎসাহ করত। এ ধরনের কাজে এখনো তেমন উৎসাহ তাদের দেখা যায় না। তবে দিন বদলেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দেশের উপকূলবাসীকে রক্ষা করতে এখন নদী খননের নানা প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। বাইরে থেকে এ খাতে অর্থও মিলছে। এখন উপকূল অঞ্চলের পাশাপাশি হাওরাঞ্চলেও যে নদী খননের ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া জরুরি সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে নীতিনির্ধারকদের সামনে। তা না হলে বিপদ আরো বাড়বে।
বেশ কয়েক বছর আগেই ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডাব্লিউএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের হাওরগুলোর পানির উচ্চতা প্রাক-বর্ষা মৌসুমে ০.৩ থেকে ০.৬ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সুনামগঞ্জের কর্চার হাওরের পানির উচ্চতা ০.৩ মিটার এবং সিলেটের জিলকর ও মৌলভীবাজারের কাওয়ারদীঘি হাওরের পানির উচ্চতা ০.৬ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যাবে। তেমনটি হলে কৃষকরা সময়মতো চাষ শুরু করলেও ফসল তোলা খুব কঠিন হয়ে পড়বে।
বৈশাখে আগাম বন্যায় হাওরের ফসল তলিয়ে গেলেও ফাল্গুন-চৈত্র মাসে সেখানে সেচ দেওয়ার মতো পানি থাকে না নদ-নদীতে। অথচ কয়েক দশক আগেও ওই অঞ্চলের কোনো কোনো নদী দিয়ে সারা বছর বড় ডাবল ডেকার লঞ্চ, কার্গো, স্টিমার চলাচল করত। আর তখন হাওর রক্ষায় কোনো বেড়িবাঁধও ছিল না। হাওরের পানি নিষ্কাশনের খালগুলোতে শুধু পানি আসার আগে বাঁধ দেওয়া হতো। সেটাও দিত এলাকার কৃষকরা নিজ উদ্যোগেই। তাতেই রক্ষা পেত হাওরের ফসল। এমনকি কোনো কোনো বছর ফসল কাটার পর জমিতে থাকা গোড়া বা নাড়া থেকে নতুন করে কুশি গজাত এবং তা থেকে মিলত মুরি ফসল। এলাকার অসচ্ছল লোকজন সংগ্রহ করত সেই মুরি ফসল, যাকে নেত্রকোনা-সুনামগঞ্জের হাওরের মানুষ বলত ‘ডেমি’। অথচ এখন বাঁধ দিয়েও মূল ফসলই তোলা যাচ্ছে না।
জলবায়ু যেভাবে বদলে যাচ্ছে তাতে শুধু হাওরে বাঁধের উচ্চতা বাড়িয়ে যে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না—সে সত্যটি দিন দিনই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ বছর হাওরে যে দুর্যোগ দেখা দিয়েছে তা মোকাবেলা করার জন্য আশু ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি যেমন হাতে নেওয়া দরকার, তেমনি হাওরের কৃষকের কান্না স্থায়ীভাবে থামাতে হলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও হাওরাঞ্চলের নদীগুলো খনন করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। বাঁধের ভেতরে থাকা মরা নদী, খাল-বিলও খনন করা দরকার। আশার কথা, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সম্প্রতি আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে হাওরাঞ্চলের ফসল রক্ষায় সব নদী খনন ও প্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তবে সব কাজের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে স্থানীয়ভাবেও। যেমন বাঁধের ভেতরের মরা নদী ও খাল-বিল খনন এবং বাঁধের দুই পাশে জলজ বৃক্ষরোপণের মতো কাজগুলো স্থানীয় সরকার উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সহায়তা নিয়ে, এমনকি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতেও করতে পারে। সব কিছুর আগে দরকার ব্যাপক জনসচেতনতা ও গণজাগরণ।