আজাদুর রহমান চন্দন
কমরেড মণি সিংহ একটি আদর্শের প্রতীক, একটি সংগ্রামের প্রতীক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রবাদতুল্য পুরুষ তিনি। ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ উপমহাদেশের শোষণমুক্তি ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রথম বার্তাবহদের একজন। বিদেশি শাসনের শৃঙ্খল থেকে উপমহাদেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে অসহযোগ খেলাফত আন্দোলনের আমলে যে বিপ্লবী তরুণরা সর্বস্ব ছেড়ে সামনের সারিতে এসে যোগ দিয়েছিলেন, মণি সিংহ তাঁদের অন্যতম। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরাধীনতা থেকে উপমহাদেশকে স্বাধীন করার লড়াই এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের মহানায়ক তিনি। দীর্ঘ সাত দশক ধরে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের পাশাপাশি এ দেশের শোষিত-নিপীড়িত-মেহনতি মানুষের চূড়ান্ত মুক্তির জন্য কমিউনিস্ট আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার েেত্র যে অবদান তিনি রেখে গেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বাধীনতা সংগ্রামে মেহনতি জনতার ভূমিকা যাঁদের উদ্যোগে প্রবল ও প্রধান হয়ে ওঠে, মণি সিংহ তাঁদের অন্যতম। স্বাধীনতা সংগ্রামের কর্মকাণ্ডে সর্বহারা, কৃষক, মজুর ও বিত্তহীন বুদ্ধিজীবীদের আশা-আকাক্সাকে পুরোভাগে আনার চেষ্টা করেন তিনি।
১৯০১ সালের ২৮ জুলাই কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে মণি সিংহের জন্ম। মাত্র আড়াই বছর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটলে পরিবার সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে। ওই সময় কিছুদিন ঢাকায় তাঁর মামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সুরেন সিংহের বাড়িতে থাকেন তাঁরা। মণি সিংহের মাতামহ (নানা) ছিলেন তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) সুসং-দুর্গাপুরের জমিদার। সেই সূত্রে মণি সিংহের বিধবা মা জমিদারদের কাছ থেকে বসতবাড়িসহ কিছু সম্পত্তি, বার্ষিক খোরাকি ও শরিক হিসেবে মাসোহারা পান। মণি সিংহের বয়স যখন সাত বছর, তখন থেকে সুসং-দুর্গাপুরেই বাস করতে থাকেন তাঁরা। সেখানেই প্রাথমিক শিা শেষ করেন মণি সিংহ।
সংগ্রামের পথে যাত্রা : সুসং-দুর্গাপুরে প্রাথমিক শিা শেষ করে কলকাতায় যান মণি সিংহ মাধ্যমিক শিার জন্য। ওই সময়ই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতি ঘৃণা ও বিরোধিতার বীজ অঙ্কুরিত হয় তাঁর মনে। সে অবস্থায় ১৯১৪ সালে কিশোর মণি সিংহ যোগ দেন ‘অনুশীলন’ দলে এবং ক্রমশ বাংলার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিজের স্থান করে নেন।
১৯২১ সালে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের ঐতিহাসিক গণজাগরণ তরুণ মণি সিংহের মনে গভীর রেখাপাত করে এবং সংগ্রামের সহিংস পদ্ধতি সম্পর্কে দেখা দেয় সংশয়। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রামে কৃষকদের টেনে আনার উদ্দেশে তিনি নিজ জেলার কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। শুধু তাই নয়, শিার সুযোগ-বঞ্চিত হাজং কৃষক-সন্তানদের জন্য পরপর পাঁচটি স্থানে পাঠশালা চালু করেন সহযোগীদের নিয়ে।
রুশ বিপ্লবের প্রত্যদর্শী এবং ওই বিপ্লবের আদর্শে উদ্বুদ্ধ বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে সুসংয়ে দেখা হয় তাঁর ১৯২৫ সালে। গোপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর মণি সিংহ মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং কলকাতায় গিয়ে চূড়ান্তভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করেন ‘অনুশীলন’ দলের সঙ্গে।
শ্রমিক আন্দোলনের সফল নেতা : ১৯২৬ সালের গোড়ার দিকে মণি সিংহ কলকাতায় কাইভ স্ট্রিটের গুপ্ত ম্যানসনে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে ‘ওরিয়েন্টাল ট্রেডিং’ নাম দিয়ে একটি অফিস খুলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার উপায় খুঁজে বের করা। কলকাতায় গিয়ে গোপেন চক্রবর্তী, ধরণী গোস্বামী, নীরোদ চক্রবর্তী, নলীন্দ্র সেন প্রমুখের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তাঁরা সবাই ছিলেন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন। ওই সময় পার্টির নেতৃত্বাধীন কোনো শ্রমিক সংগঠন না থাকায় শুরুতেই কোনো শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেননি মণি সিংহ। তখন তিনি হ্যারিসন রোডে কমরেড মুজফ্ফর আহমদের অফিসে গিয়ে নিয়মিত ‘গণবাণী’ পত্রিকা পড়তেন। মুজফ্ফর আহমদও যেতেন কাইভ স্ট্রিটের অফিসে। ১৯২৮ সালের প্রথম দিকে একদিন গোপেন চক্রবর্তী ও ধরণী গোস্বামী জানালেন, শ্রমিক আন্দোলনের সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। কেসি মিত্র (কিরণ চন্দ্র মিত্র) ওরফে জটাধারী বাবা লিলুয়া রেলওয়ে কারখানায় ধর্মঘট করেছেন। সেখানে প্রচারের জন্য বহু কর্মী দরকার। এ সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। পরদনিই লিলুয়া রেলওয়ে ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে হাজির হন মণি সিংহ। এরইমধ্যে মেটিয়াবুরুজের কেশোরাম টেক্সটাইল মিলের এক অবাঙালি শ্রমিক গিয়ে সেখানে জটাধারী বাবার খোঁজ করেন। কেশোরাম কটন মিলে তারা তখন হরতাল করছিলেন। সেজন্য জটাধারী বাবাকে তারা সেখানে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু জটাধারী বাবার অনুপস্থিতির সুযোগে তাঁর লোক বলে পরিচয় দিয়ে গোপেন চক্রবতী, মণি সিংহ ও ধরণী গোস্বামী চলে যান মেটিয়াবুরুজে। সেখানে শ্রমিকরা তাঁদের পেয়ে খুশি। কিন্তু অবাঙালি শ্রমিকদের মুখের ভাষা বুঝতে না পারায় এবং মিল সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় মণি সিংহ প্রথমে সেখানে কাজ করার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। লিলুয়ায় ফিরে গিয়ে নিজের এ সমস্যার কথা জানান তিনি। তা সত্ত্বেও গোপেন চক্রবর্তী ও ধরণী গোস্বামীর পীড়াপীড়িতে মেটিয়াবুরুজে যেতে রাজি হলেন মণি সিংহ।
মেটিয়াবুরুজ একটি শ্রমিক এলাকা। কলকাতা থেকে আট মাইল দণি-পশ্চিমে। সেখানে তখন কেশোরাম কটন মিল ছাড়াও ছিল চটকল, জাহাজ মেরামত কারখানা, গার্ডেন রিচ ওয়ার্কশপ, আইজিএন ওয়ার্কশপ, বদরতলায় ইউনিয়ন জুট মিল, কাইভ জুট মিল, ম্যাচ ফ্যাক্টরি প্রভৃতি। মণি সিংহ সেখানে শ্রমকিদের সাহায্যে একটা ছোট অফিস ভাড়া নিলেন। কাজের পাশাপাশি শিখতে লাগলেন হিন্দি ও উর্দু। অল্প সময়ের ব্যবধানেই তিনি কেশোরাম কটন মিলে ১৩ দিনব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে দাবি আদায় করতে সম হন।
প্রথম বারেই জেলে কাটে পাঁচ বছর
১৯৩০ সালে মাস্টার দা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুটের ঘটনায় ব্রিটিশ সরকার পাগলা কুকুরের মতো প্তি হয়ে ওঠে। নির্বিচারে ধরপাকড় চালায়। বিনা বিচারে আটক রাখা হয় শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে। রাজনৈতিক এ পটভূমিতে ওই বছর ৯ মে কলকাতায় গ্রেপ্তার হন মণি সিংহ। টানা পাঁচ বছর বিভিন্ন জেল-ক্যাম্প ঘুরিয়ে ১৯৩৫ সালে সুসংয়ে নিজ গ্রামের বাড়িতে নজরবন্দি করে রাখা হয় তাঁকে। প্রতিদিন বিকেলে থানায় হাজিরা দিতে হতো। তবে এখানে তাঁর সুবিধাও ছিল কিছুটা। চলাফেরার চৌহদ্দিটা ছিল বেশ বড়। বাড়ি থেকে আধা মাইল দূরে ছিল কৃষকদের গ্রাম। সেখানে বাস করতেন মুসলমান কৃষকরা। তারা ছিলেন টঙ্ক প্রথার অত্যাচারে জর্জরিত। কৃষকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারেন মণি সিংহ। কৃষকরা তাঁকে জানান, অবিলম্বে তারা এ প্রথার অবসান চান। মণি সিংহ তাদের আশ্বস্ত করেন এই বলে, ‘আপনারা যদি সব একজোট হয়ে আন্দোলন করেন, তবে নিশ্চয়ই টঙ্কপ্রথা উচ্ছেদ হয়ে যাবে।’
এরই মধ্যে মাতুল বংশের এক জমিদারের সঙ্গে মণি সিংহের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় একটি অন্যায়ের বিরোধিতা করা নিয়ে। জমিদার এক রাজমিস্ত্রিকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে চাইলে মণি সিংহ ওই রাজমিস্ত্রির প নেন। এ কারণে মণি সিংহের নামে আইবির কাছে অভিযোগ পাঠান জমিদার। আভিযোগে বলা হয়, মণি সিংহ এখানে রাজনীতি করছেন। ওই সময় নেত্রকোনার মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) পাট চাষ কমানোর বিষয় নিয়ে সুসংয়ে চাষীদের এক সভা আহ্বান করেন। জমিদারের অভিযোগের কারণে জেল অবধারিত মনে করে মণি সিংহ ঠিক করলেন, জেল যখন হবেই তখন জনতার অজান্তে জেলে যাওয়ার চেয়ে তাদের মধ্যে প্রচার করে যাওয়াই শ্রেয়। আর এ চিন্তা থেকেই এসডিওর ডাকা মিটিংয়ে তিনি কৃষকদের প নিয়ে পাট চাষের ব্যাপারে জোরালো বক্তব্য রাখেন। এর ফলে তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আপিলে অবশ্য তা কমে দেড় বছরে দাঁড়ায়।
জীবন-সংগ্রামের টার্নিং পয়েন্ট : অন্তরিন অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৩৭ সালে মণি সিংহ মাকে দেখার জন্য সুসংয়ে আসেন। এবার তাঁর জীবনে নাটকীয় মোড় পরিবর্তন ঘটে। ওই এলাকার দশাল গ্রামের মুসলমান কৃষকরা টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামে মণি সিংহের সাহায্য কামনা করেন। টঙ্ক ছিল টাকার বদলে ধানে চুক্তিবদ্ধ হারে খাজনা পরিশোধের প্রথা। ফলন না হলেও নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান খাজনা হিসেবে জমিদারকে দিতে হতো। খাজনা আদায়ের জন্য জমিদাররা কৃষকদের ওপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালাতো। মণি সিংহ গ্রামে যাওয়ার দু’তিন দিনের মধ্যেই মুসলিম কৃষকরা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। আট-দশ জন বয়স্ক মুসলিম কৃষক মণি সিংহের বাড়িতে গিয়ে বলেন, ‘খোদার রহমতে আপনে খালাস পাইছেনÑআমরা খুব খুশি হইছি। এহন আপনে টঙ্কটা লইয়া লাগুইন। আমরা আর টঙ্কের জ্বালায় বাঁচতাছি না।’ জবাবে মণি সিংহ বলেন, ‘আমি কলকাতায় শ্রমিক আন্দোলন করি, মাকে দেখার উদ্দেশ্যে সাতদিনের জন্য বাড়ি এসেছি, কাজেই আমি ফিরে যাবো।’ কিন্তু কৃষকরা নাছোরবান্দা। তাদের কথা, ‘এডা হয় না। দেশের চাওয়াল দেশে থাকিয়া টঙ্ক লইয়া লাগুইন। আমরা যাতে বাঁচি তার চেষ্টা করুইন। খোদা আপনার ভালা করব।’ মণি সিংহ তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত পাঠালেও প্রতিদিনই তারা গিয়ে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন।
এরই এক পর্যায়ে মণি সিংহের নিজের মনেই এক রূঢ় বাস্তব প্রশ্নের উদয় হলো। তিনি নিজে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এভাবে :
‘চার-পাঁচ দিন পর–একদিন রাত্রিবেলায় শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলাম যে, আমি কি ট্রেড ইউনিয়ন কাজের জন্য কলকাতা যেতে উদগ্রীব? ওই সময়ে মেটিয়াবুরুজে একটি ট্রেড ইউনিয়নের বেস (নধংব) সৃষ্টি হয়েছিল, কারণ আমরা প্রতিটি শ্রমিক-সংগ্রামে জয়লাভ করেছিলাম। এখানে টঙ্ক আন্দোলন করা জটিল ও কঠিন ব্যাপার। কারণ যাদের বিরুদ্ধে টঙ্ক আন্দোলন করতে হবে, তাঁরা সবাই আমার আÍীয়। কেবল তাই নয়, আমার নিজ পরিবারেরও টঙ্ক জমি আছে। কাজেই সকলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। হয়ত এইসব কারণে আমি পিছিয়ে যাচ্ছি। এই কথা যখন আমার মনে উদয় হল, তখন আমার মধ্যে এক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হল। ট্রেড ইউনিয়ন না টঙ্ক আন্দোলন? আমি ভাবতে লাগলাম আমি যদি মার্কসবাদ-লেলিনবাদে বিশ্বাসী হই, যদি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ গ্রহণ করে থাকি, তবে যেখানে আমার এবং আমার পরিবারের স্বার্থ নিহিত রয়েছে–প্রয়োজনে ও আদর্শের জন্য তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা আমার কর্তব্য। যা অন্যায়, যা সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ তার বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করা উচিত। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে চেতনা উদ্দীপিত করা ও তাঁদের সংগঠিত করা একান্ত প্রয়োজন। এবং এভাবেই দেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রসর করে নেওয়া সম্ভব। এটা আমার আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এখানে আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ নিহিত আছে বলে আমি ঐ আন্দোলন হতে কখনোই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি না। আমার স্বার্থ আছে বলেই আমাকে কৃষকদের নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কৃষকদের এই সংগ্রামে সাথী হয়ে যদি এই সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারি, তবেই আমার সঠিক পথে যাত্রা শুরু হবে। এটা আমার জীবনের পরীার মূল। এই পরীায় আমাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে। এই দ্বন্দ্ব আমার মধ্যে চলতে লাগল; যাঁর সাথে পরামর্শ করতে পারি এমন কোন বন্ধুও তখন ছিল না। আমার মন ও মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শই ছিল আমার বড় বন্ধু। …সমগ্র ময়মনসিংহ জেলায় এমন একজন কেউ ছিল না যাঁর সাথে পরামর্শ করা যেতে পারে। … আমার যতটুকু মার্কসবাদ-লেনিনবাদের জ্ঞান ছিল, আর যেটুকু শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাকেই ভিত্তি করে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, টঙ্ক আন্দোলনে আমি সর্বতোভাবে শরিক হবো।’
টঙ্করাজা মণি সিংহ : টঙ্ক আন্দোলনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েই মণি সিংহ পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেন। সে অনুযায়ী ১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে একদিন গিয়ে হাজির হন দশাল গ্রামে। বয়স্ক কৃষকদের ডেকে বলেন, জমিদারদের ঋণ আদায়ের আগেই আন্দোলন শুরু করে দিতে হবে। কাজেই বৈঠক ডাকতে বলেন তাদের। শুনে কৃষকরাও খুব খুশি। শুরু হলো গ্রামে গ্রামে বৈঠক। কৃষকরাও আন্দোলনের কথা প্রচার করে দিলেন গ্রামে গ্রামে। অল্প দিনের মধ্যেই এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো টঙ্ক আন্দোলনের কথা। সাড়া পাওয়া গেলো আশাতীত। মুসলিম ও হাজং অধ্যুষিত গ্রামে সমভাবেই চলতে থাকে আন্দোলন। ওই সময় পুলিশ গ্রামে গ্রামে ঘুরে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। মণি সিংহের বিচণতার কারণে বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে সম হন কৃষকরা। মাঘ মাসে ধান আদায়ের সময় দেখা গেলো এক-চতুর্থাংশের বেশি আদায় করতে পারেনি জমিদাররা। গ্রামে মণি সিংহেরও এক টঙ্কদার ছিল। তার টঙ্ক ছিল বছরে ৬০ মণ। মণি সিংহ ওই টঙ্ক মওকুফ করে দেন। টঙ্ক আন্দোলনের ফলে কি জমিদার, কি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় উভয়েই প্তি হয়ে ওঠে মণি সিংহের ওপর। তারা নানা অপবাদ রটাতে থাকে তাঁর নামে। বিয়েসহ অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে তাঁকে দাওয়াত দেওয়াও বন্ধ করে দেয় মধ্যবিত্তরা। কিন্তু কোনো কিছুই টলাতে পারেনি মণি সিংহকে। আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে এক পর্যায়ে ১৯৪০ সালে সরকার সার্ভে করে টঙ্কের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে গভর্নর টঙ্ক এলাকা পরিদর্শনে যান। তার আগেই কয়েকজন সহকর্মীসহ মণি সিংহকে গ্রেপ্তার করে ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ছাড়া পেয়ে পরিস্থিত বুঝে আÍগোপন করেন তিনি।
ব্রিটিশ সরকার টঙ্ক প্রথার সংস্কার করলেও প্রথাটি উচ্ছেদ হলো না। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন-কৃষক সভা এই সংস্কার গ্রহণ বা বর্জন কোনটাই না করে টঙ্ক প্রথার পুরোপুরি উচ্ছেদ চাইলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদবিরোধী ‘জনুযুদ্ধের’ নীতি গ্রহণ করায় ১৯৪১ সাল থেকে ওই আন্দোলন সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। ১৯৪৪ সালে মণি সিংহ সারা বাংলার কৃষান সভার প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষান সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মণি সিংহ ছিলেন সম্মেলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত ভারতের সাধারণ নির্বাচনে তিনি তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার একটি আসন (বর্তমান নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার কয়েকটি থানা নিয়ে গঠিত) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও টঙ্ক আন্দোলন চলতে থাকলে ১৯৫০ সালে টঙ্কের পরিবর্তে টাকায় খাজনার নিয়ম চালু হয়। স্বীকৃত হয় জমিতে কৃষকের স্বত্ব। মণি সিংহের নেতৃত্বে এই সামন্ততান্ত্রিক শোষণব্যবস্থা উচ্ছেদের জন্য নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ সদর ও জামালপুর মহকুমার পাঁচটি থানায় আটশ’ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে দীর্ঘ ১২ বছর নানা ধরনের প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। এতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন নারী-পুরুষ-শিশুসহ ৬০ জন সংগ্রামী। কৃষকদের শত শত বাড়িঘর ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে পুরো গ্রামও। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এলাকায় কৃষকসভা ও কমিউনিস্ট পার্টির শক্তিশালী গ্রাসরুট (তৃণমূল) সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এমনকি সেখান থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে পাঠানো হতো প্রাদেশিক কমিটিতে। এ সাফল্য অর্জন করতে গিয়ে মণি সিংহকে কম নির্যাতন হয়রানি সহ্য করতে হয়নি। পাকিস্তানে প্রথম মুসলিম লীগ সরকার মণি সিংহের বাড়িঘর ভেঙে ভিটায় হালচাষ করিয়েছিল। নিলাম করে দিয়েছিল তাঁর স্থাবর সম্পত্তি। কিন্তু জনতার হƒদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন তিনি শক্তভাবে, যে কারণে ওই সময় জেলে থাকা অবস্থায় শ্লোগান উঠেছিল, ‘টঙ্করাজা মণি সিংহের মুক্তি চাই’।
ধরিয়ে দিতে দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা : পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাসে গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত বলতে গেলে টানা ২০ বছরই আÍগোপনে থাকতে বাধ্য হন মণি সিংহ। ১৯৪৮ সালে অল্প কয়েকদিন এবং ১৯৫৫ সালে আবু হোসেন সরকারের সময় এক মাস তিনি প্রকাশ্যে থাকতে পেরেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি ছিল এবং আইউব সরকার তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ১৯৬৯ সালে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর ২২ ফেব্র“য়ারি তিনি অন্যান্য জাতীয় নেতার সঙ্গে কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। ওই বছরই ২৫ মার্চ পুনরায় সামরিক আইন জারি হলে আবার আÍগোপনে চলে যান তিনি। আÍগোপন অবস্থায় সে বছর জুলাই মাসে আবার তিনি গ্রেপ্তার হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসে বন্দিরা রাজশাহী কারাগার ভেঙে তাঁকে মুক্ত করে। স্বাধীন বাংলাদেশেও ১৯৮০ সালে জিয়া সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘদিন কারাগারে আটকে রাখে।
প্রকৃত ডিক্লাসড কমিউনিস্ট : জমিদার পরিবারের উত্তরসূরি হয়েও মণি সিংহ শ্রমিক আন্দোলনে, টঙ্ক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, নের্তৃত্ব দিয়েছেন। এটা করতে গিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে শ্রেণীচ্যুতও (ফবপষধংংবফ) করেছেন তিনি। নিজের পারিবারিক-সামাজিক অবস্থান কিংবা সুযোগ-সুবিধা ধরে রাখার কোনো চেষ্টাই করেননি। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজের নিলাম হওয়া বাড়ি-জমি ফেরত পাওয়ার সুযোগ পেয়েও তা নেননি। বঙ্গবন্ধু মণি সিংহকে তাঁর বাড়ি-জমি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলে জবাবে মণি সিংহ বলেছিলেন, ‘সবার জন্য সাম্যের সমাজ হবেÑএ স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হয়েছি। যখন সবার হবে, তখন আমারও হবে।’
পার্টি নেতা ও বড় ভাই : ১৯২৫ সালে কমিউনিস্ট আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯২৮ সাল থেকেই পার্টির সার্বণিক কর্মী হয়ে যান মণি সিংহ। তখন পার্টিতে সদস্যপদ দেওয়া হতো খুবই সঙ্কীর্ণ ভিত্তিতে। কাজেই শ্রমিক আন্দোলনে একনিষ্ঠভাবে সক্রিয় থেকেও তখনো পার্টির সদস্যপদ পাননি তিনি। তবে কমরেড মুজফ্ফর আহমদ তাঁকে ১৯২৮ সালেই নিয়ে নেন ওয়ার্কাস অ্যান্ড পিজেন্টস পার্টিতে। এটি ছিল একটি প্রকাশ্য বামপন্থী দল। পরে ১৯৩৭ সালে জেল থেকে মুক্তি পেলে মণি সিংহকে জানানো হয় যে, তিনি পার্টিসদস্য। ১৯৪২ সালে তিনি পার্টির ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সালে বোম্বেতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলনে ময়মনসিংহ জেলার প্রতিনিধি ছিলেন দু’জনÑপুলিন বক্সী ও মণি সিংহ। ১৯৫১ সালে পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলনে মণি সিংহকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ প্রাদেশিক কমিটির সম্পাদক (সাধারণ সম্পাদক) নির্বাচিত করা হয়। পার্টির গোপন অবস্থায় ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনেও তিনি ওই পদে পুনর্নির্বাচিত হন। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে পার্টির চতুর্থ সম্মেলনে (যা ঘোষিত হয়েছিল পার্টির প্রথম কংগ্রেস হিসেবে) নির্বাচিত হন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে এবং ১৯৮০ সালে তৃতীয় কংগ্রেসে কমরেড মণি সিংহ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন শয্যাশায়ী। কমিউনিস্ট পার্টির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তাঁকে সম্বোধন করতেন ‘বড়ভাই’ বলে।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক : ১৯৭১ সালের এপ্রিলে জেল থেকে বেরিয়েই মণি সিংহ শরিক হন মুক্তিযুদ্ধে এবং বিশেষ রাজনৈতিক অবদান রাখেন। যুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ রাখা, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের নানা অপপ্রচার মোকাবিলায় নিরলস চেষ্টা চালান তিনি। তাঁর চেষ্টায়ই গড়ে ওঠেছিল ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকে জনগণের যুদ্ধ হিসেবে দেশে বিদেশে তুলে ধরা এবং এর প্রতি বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক শিবির ও বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন আদায়ে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ সালে তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে।
প্রশ্রয় পায়নি সুবিধাবাদ : সব আন্দোলন-সংগ্রাম বা কাজে যে মণি সিংহ সফলতা পেয়েছেন এমন নয়। তাই বলে হতাশা কখনো গ্রাস করতে পারেনি তাঁকে। সুবিধাবাদের কানাগলিতেও পা বাড়াননি তিনি। সিপিবির তৃতীয় কংগ্রেসের আগে পার্টির খসড়া দলিল ও রিপোর্ট নিয়ে ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় যে আলোচনা তিনি উত্থাপন করেন, তাতে সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে তাঁর বিপ্লবী দৃঢ়তার পরিচয় মেলে। ওই সময় কৌশলে পার্টির নাম বদল করে কার্যত একটি ঢিলেঢালা ধরনের বিপ্লবী গণতন্ত্রী পার্টি করার প্রস্তাব তোলা হয়েছিল দলের ভেতরে। ওই প্রস্তাবের পে যুক্তি হিসেবে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের ভোট কম পাওয়ার বিষয়টি সামনে আনা হয়। এব জবাবে সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় মণি সিংহ বলেছিলেন, ‘নাম বদলালেই সবাই আসবে না। তারা আস্তে আস্তে দাবি করবে–ডেমোক্র্যাটিক সেন্ট্রালিজম কেটে দিতে হবে, ডিক্টেরশিপ অব প্রলেতারিয়েত কেটে দিতে হবে, ইন্টারন্যাশনালিজম কেটে দিতে হবে, মার্কসিজম-লেনিনিজম কেটে দিতে হবে–ফরাসি পার্টির মতো। তারা কমিউনিস্ট পার্টির কনটেন্টই নষ্ট করে দেবে।’ ওই প্রস্তাব উত্থাপনকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘একটা নির্বাচনে হেরে গিয়েই তোমরা এসব ভাবছ! এর চেয়ে অনেক কঠিন অবস্থার মধ্যদিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি কাজ করেছে। …নামের জন্য ভোট দেয় নাই এমন নয়। কাজ করি নাই এজন্য ভোট দেয় নাই। …জাসদ ভোট পেয়েছে। কেননা ভুল হোক শুদ্ধ হোক লড়াই করেছে। জনতার সঙ্গে ছিল। মেড ইজি হবে না। এলাকায় গেলেই সঙ্গে সঙ্গে রেজাল্ট হবে না। সময় লাগবে।’ স্বাধীনতা-উত্তর কালে পার্টির দুর্বলতা প্রসঙ্গে মণি সিংহ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সময় আমরা শ্রেণীসংগ্রাম সব ভুলে গেলাম। কমিউনিস্ট পার্টির একটা পলিটিক্যাল ডিরেকশন থাকলো না। সেলফলেস ক্যাডার গড়ে তোলা হয় নাই।’
দৃঢ়চেতা হলেও কর্তৃত্ববাদী ছিলেন না : নীতি-আদর্শ ও শৃঙ্খলার প্রতি মণি সিংহ ছিলেন সবসময় অবিচল। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা সকল স্তরের মানুষকে আকৃষ্ট করতো। পার্টির নেতা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতা-কর্মীদের ‘বড়ভাই’ হয়ে উঠলেও যৌথ নের্তৃত্বের প্রতি আস্থাবান ছিলেন তিনি। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার লেনিনীয় নীতি তিনি মেনে চলতেন প্রতি পদে। এটা করতে গিয়ে কখনো কখনো মানুষ তাঁকে ভুল বুঝেছে। তা সত্ত্বেও দলের যৌথ সিদ্ধান্ত (যার সঙ্গে তিনি একমত ছিলেন না) মেনে চলা থেকে তিনি বিরত থাকেননি। নিজের মত না থাকা সত্ত্বেও দলের সিদ্ধান্ত মেনে বঙ্গবন্ধুর সময় বাকশালে যোগদান, জিয়াউর রহমানের সময় তার কিছু কর্মসূচিকে সমর্থন দেওয়া–এসব ঘটনা তারই নজির।
স্বপ্নবান মানুষ : স্বপ্ন কম-বেশি অনেকেই দেখেন। কিন্তু দুর্যোগ মুহূর্তেও স্বপ্ন দেখেন এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। আর নিজের স্বপ্ন অন্যের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া, অন্যকেও স্বপ্ন দেখানো–সে এক দুঃসাধ্য কাজই বটে। সেই দুঃসাধ্য কাজটি করতে পারতেন মণি সিংহ। তাঁর জীবদ্দশায় বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল চৌদ্দটি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশ হবে বিশ্বের পঞ্চদশ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। নিজের এই স্বপ্নের কথা, বিশ্বাসের কথা বলেছেনও অকপটে অনুসারীদের কাছে। এমনকি তাদের এটা বিশ্বাস করাতেও সম হয়েছিলেন তিনি।
মৃত্যুহীন প্রাণ : ১৯৮৪ সালে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই কমরেড মণি সিংহ ছিলেন শয্যাশায়ী। প্রথমে হারান সোজা হয়ে চলার শক্তি এবং শেষে বাকশক্তিও হারিয়ে ফেলেন। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার পতনের আনন্দের রেশ তখনও কাটেনি–এমনি এক দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জননেতা মণি সিংহ। বয়স তখন তাঁর ৯০। তা সত্ত্বেও কারো কাছেই তাঁর এ মৃত্যু প্রত্যাশিত ছিল না। মৃত্যুতেই অবশ্য নিঃশেষ হয়ে যাননি তিনি।
মণি সিংহের আÍজীবনমূলক গ্রন্থ ‘জীবন-সংগ্রাম’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। তাতে নিজের চেয়ে অবশ্য অন্যদের মহত্বকেই বড় করে তুলে ধরেছেন তিনি। তাঁর ত্যাগী নির্মোহ জীবনাদর্শ আজো রাজনৈতিক কর্মীদের প্রেরণা জোগায়। তাঁর বিপ্লবী জীবন অনন্তকাল প্রেরণা জোগাবে মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত রাজনৈতিক কর্মীদের। কেননা মণি সিংহের সমগ্র জীবনই ছিল মুক্তিসংগ্রামে নিবেদিত। কখনো কোনো রকম হতাশা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। টলাতে পারেনি কোনো রক্তচু তাঁকে।
মণি সিংহের জীবদ্দশায়ই তাঁর ৮০তম জš§দিনে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দিন বলেছিলেন, ‘মণিসিংহের মতো এতো দীর্ঘদিন একনিষ্ঠভাবে আদর্শের প্রতি অনুগত ও কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিত্ব আমাদের রাজনীতির েেত্র বিরল। তাঁর বিপ্লবী জীবনে মহাকাব্য বা বৃহৎ উপন্যাসের উপকরণ আছে।’ মণি সিংহকে ‘ইতিহাসের যুবরাজ’ হিসেবে আখ্যা দেন কবি সুফিয়া কামাল। সত্যেন সেন ১৯৬৯ সালে মণি সিংহ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘মণি সিংহের জীবনের মধ্যে আদপে জনগণের জীবনই অভিব্যক্তি পেয়েছে। মণি সিংহের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অগণিত নামী-বেনামী মেহনতি মানুষের আশা-আকাক্সা, ত্যাগ-তিতিার সংগ্রাম। মণি সিংহের অতীত জীবনকে জানার মধ্য দিয়ে জনসাধারণ নিজেদের অতীতকে দেখতে পাবেন।’
এ বিপ্লবী জননেতার স্মৃতি ও আদর্শকে সুমন্নত রাখার শপথ নিয়ে সুসং-দুর্গপুরে প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর থেকে প্রায় সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় কমরেড মণি সিংহ মেলা। বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রায় সব জেলা-উপজেলার প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সমাবেশ ঘটে সেখানে। রাজধানী ঢাকা থেকেও রাজনীতিক, সমাজসেবী, পেশাজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীরা অংশ নেন এ মেলায়।
পরিবার পরিচিতি : মণি সিংহের স্ত্রী অনিমা সিংহও ছিলেন সংগ্রামী কৃষক নেত্রী। ১৯৮০ সালে এক সড়ক দূর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারান। একমাত্র ছেলে দিবালোকে সিংহ একজন চিকিৎসক ও রাজনৈতিক নেতা। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তিনি। তাঁর স্ত্রী সাকী খন্দকারও পেশায় চিকিৎসক। তিনিও পার্টির নারী শাখার নেত্রী। তাঁদের একমাত্র ছেলে অনিক সিংহ এখনও ছাত্র। কার্যত গোটা পার্টিকেই মণি সিংহ নিজের পরিবার করে নিয়েছিলেন। বিপ্লবী দৃঢ়তার পাশাপাশি তাঁর মধ্যে ছিল অনাবিল শিশুর সারল্য। যিনিই তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তিনিই পেয়েছেন তাঁর এ সারল্যের পরিচয়। শোষিত-বঞ্চিত-মেহনতি মানুষের জন্য তাঁর অন্তর ছিল দরদ ও সহানুভূতিতে সিক্ত।